লেখা: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পর্ব ১- ইংরেজি ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষার। এর অর্থ হলো ‘শিক্ষক’ বা ‘প্রশিক্ষক’। মধ্যযুগের দিকে ইউরোপে যারা ল্যাটিন ভাষা পড়াতেন, তাদের একটি লাইসেন্স লাগতো, যার নাম ছিলো ‘Licentia Docendi’, এবং এই লাইসেন্টিয়া ডোসেন্ডির ইংরেজি অনুবাদ হলো ‘License to Teach’, অর্থাৎ শেখানোর লাইসেন্স। এ লাইসেন্সটিকে ডাকা হতো ‘Doctoratus’, যার ইংরেজি হলো ‘Doctorate’, এবং এ লাইসেন্স যার থাকতো, তাকেই বলা হতো ডক্টর, আর ডক্টর মানে হলো শিক্ষক!
তখনকার দিনে ডক্টর ছিলেন চার্চের মোল্লারা, যারা বাইবেল পড়াতেন ও ব্যাখ্যা করতেন। চার্চের অনুমতি ছাড়া কেউ ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’ বা ‘শেখানোর লাইসেন্স’ পেতেন না। কিন্তু খ্রিস্টানদের পোপ ১২১৩ সালে ঘোষণা করলেন যে, আজ থেকে চার্চের পাশাপাশি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ও শেখানোর লাইসেন্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবে। এই ঘোষণার আগেও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাথোলিক চার্চের অনুমতি নিয়ে কিছু ছাত্রকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতো। কিথ এলান তাঁর ‘Changing doctoral degrees: an international perspective’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবীর প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিটি দেয়া হয় ১১৫০ সালের দিকে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে।
তখনকার দিনে খ্রিস্টানদের এই ডক্টরেট ডিগ্রির মতো আরেকটি ডক্টরেট ডিগ্রি মুসলিমদেরও ছিলো। এটির নাম ছিলো ইযাজাহ। ডক্টরেট দেয়া হতো খ্রিস্টানদের চার্চ থেকে, আর ইযাজাহ দেয়া হতো মুসলিমদের মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু দুটিরই অর্থ ছিলো এক: শেখানোর লাইসেন্স। যার ডক্টরেট ও ইযাজাহ আছে, তিনি শিক্ষকতা করতে পারবেন।
তবে অধ্যাপক জর্জ মাকদাইসির মতে, ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটেছে মুসলিমদের ইযাজাহ ডিগ্রির অনুকরণে। এ কথা তিনি তাঁর ‘Scholasticism and Humanism in Classical Islam and the Christian West’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। মাকদাইসি ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সতেরো শতকের দিকে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ডক্টরেট ডিগ্রি বা শিক্ষকতার লাইসেন্সের একটি নাম দিলো ‘Doctorate of Philosophy’ বা PhD (Philosophiae Doctor), এবং বাংলাদেশের বহু পাগল এই ‘Philosophy’ শব্দের অর্থ করে থাকে দর্শন! কিন্তু এই ফিলোসোফি সেই ফিলোসোফি নয়। ডক্টরেট অব ফিলোসোফিতে যে-ফিলোসোফি শব্দটি আছে, তা মূলত গ্রীক ভাষায় শব্দটির মূল অর্থকে নির্দেশ করে। অর্থটি হলো: Love of Wisdom বা জ্ঞানের প্রতি মোহ। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, ও পদপদবী নয়, যে-ব্যক্তির জ্ঞানের প্রতি মোহ জন্মেছে, সে-ব্যক্তিই পিএইচডি! কিন্তু আমি দেখছি, ছাগলেরাও ইদানিং দলবেঁধে পিএইচডি নিচ্ছে।
ফিলোসোফি শব্দটি ব্যবহারের পেছনে অন্য কারণও আছে। ইউরোপে তখন ইতিহাস, গণিত, দর্শন, সামাজিক বিজ্ঞান, ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল বিষয়কে একত্রে ফিলোসোফি বলা হতো, এবং এখন যেটিকে ‘কলা অনুষদ’ বা ‘ফ্যাকাল্টি অব লিবারেল আর্ট’ বলা হয়, সেটি মূলত ‘ফ্যাকাল্টি অব ফিলোসোফি’ নামে পরিচিত ছিলো। এ জন্য কেউ দর্শনে ডক্টরেট না করলেও, তার ডক্টরেট ডিগ্রিকে ‘ডক্টরেট অব ফিলোসোফি’ বলা হতো। সংক্ষেপে তারা এটিকে লিখতো:
Dr. Phil.
তবে কিছু কিছু জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ডক্টরেটগুলিকে দর্শনের ডক্টরেট থেকে আলাদা করার জন্য ‘Doctor Rerum Naturalium’ বা ‘Doctor of Natural Sciences’ শব্দগুচ্ছটির ব্যবহার শুরু করে। এটিকে সংক্ষেপে লেখা হয়: Dr. rer. nat., এবং একইভাবে, কেউ সামাজিক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলে লেখা হয় Dr. rer. pol., আইন বিষয়ে করলে লেখা হয় Dr. jur. ইত্যাদি। সুতরাং জার্মানিতে যা Dr. Phil বা Dr. rer. nat. বা Dr. jur., ইংরেজি বিশ্বে তা PhD বা DPhil; বিষয় যা-ই হোক না কেন।…চলবে…