হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্ব ১- মশহুর অভিমত অনুসারে ২৪ যিলহজ্জ্ব মুবাহালার দিবস যা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। মুবাহালাহ শব্দটি আরবি ‘বাহল’ তথা ‘অভিশাপ দেয়া’ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ হচ্ছে একে অপরকে অভিশাপ দেয়া।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর পরিচালক বা প্রধানদের কাছে মহানবী (সা.) চিঠি-পত্র পাঠানোর পাশাপাশি নাজরানের আর্চবিশপ আবু হারেসার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর নাজরানের খ্রীষ্টানবাসীদের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধিদল মহানবীর (সা.) সাথে আলোচনার জন্য মদীনায় আসে। মহানবী (সা.) তাদেরকে এক-অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর ইবাদত করার এবং হযরত ঈসাকে (আ.) আল্লাহ বা খোদার পুত্র বলে যে বিশ্বাস তাদের রয়েছে তা ত্যাগ ও বর্জন করে খাঁটি তৌহীদে বিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানান।
কিন্তু খ্রীষ্টানদের ঐ প্রতিনিধিদল মহানবীর (সা.) সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হয়। তারা অচলাবস্থা থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে তাঁর (সা.) কাছে পরস্পর মুবাহালা এবং যে পক্ষ মিথ্যাবাদী তাদের উপর লানত (অভিশাপ) দেয়া ও মহান আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য প্রার্থনার প্রস্তাব দেয়।
তখন ওহীর ফেরেশতা মুবাহালার আয়াত নিয়ে অবতরণ করে মহানবীকে (সা.) জানান, যারা তাঁর ( সা.) সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং সত্য মেনে নেবে না, তাদেরকে মুবাহালা করতে আহ্বান জানাবেন এবং উভয় পক্ষ যেন মহান আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করে যে, তিনি মিথ্যাবাদীকে নিজ দয়া (রহমত) থেকে দূরে সরিয়ে দেন। পবিত্র কুরআনের মুবাহালাহ সংক্রান্ত আয়াতটি হল:
আপনার কাছে (হযরত ঈসা বা তৌহীদ) সংক্রান্ত জ্ঞান আসার পর যে কেউ আপনার সাথে বিতর্ক করে এবং (সত্য মেনে নিতে চায় না) তাকে বলে দিন: এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং তোমাদের পুত্র সন্তানদেরকে, আমাদের নারীদেরকে এবং তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে, এরপর আমরা (মহান আল্লাহর কাছে) বিনীতভাবে প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ (লানত) দেই (আলে ইমরান: ৬১)
এরপর মুবাহালার তারিখ ও স্থান নির্দিষ্ট করা হয়। মুবাহালার দিবস ও মূহুর্ত ঘনিয়ে আসলে মহানবী (সা.) নাজরানের খ্রীষ্টানদের সাথে মুবাহালাহ করার জন্য সাধারণ মুসলিম জনতা ও নিজ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কেবল তাঁর আহলুল বাইতকে (আ.) তথা হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতিমা (আ.), ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইনকে (আ.) সাথে নিয়ে মদীনা নগরীর বাইরে উন্মুক্ত মরু-প্রান্তরে নির্দিষ্ট স্থানের দিকে বের হন যা মুবাহালার জন্য আগেই ঠিক করা হয়েছিল। কারণ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তখন এ চার জনের ঈমান ও পবিত্রতার চেয়ে পবিত্রতর ও দৃঢ়তর ঈমানের অধিকারী আর কোন মুসলমান ছিল না।
মহানবী (সা.) শিশু ইমাম হুসাইনকে (আ.) কোলে নিয়েছিলেন এবং ইমাম হাসানের (আ.) হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। এ অবস্থায় হযরত আলী (আ.) এবং হযরত ফাতিমা (আ.) তাঁর (সা.) পিছে পিছে হাঁটছিলেন। মুবাহালার ময়দানে প্রবেশের আগেই তিনি (সা.) তাঁর সাথে মুবাহালায় অংশগ্রহণকারী সঙ্গীদেরকে বলেছিলেন: যখনই আমি দোয়া করব, তখন তোমরাও আমার দোয়ার সাথে সাথে আমীন বলবে। (দ্র: আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত ‘চিরভাস্বর মহানবী ( সা.), খ: ২, পৃ: ৩৬৯)
মহানবীর (সা.) মুখোমুখি হওয়ার আগেই নাজরানের প্রতিনিধি দলের নেতারা একে অপরকে বলতে লাগল: যখনই আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন যে মুহাম্মাদ (আ.) লোক-লস্কর ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মুবাহালার ময়দানে আসছেন এবং আমাদের সামনে তাঁর পার্থিব জৌলুস ও বাহ্যিক শক্তি প্রদর্শন করছেন, তখন তিনি ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী হবেন এবং তাঁর নুবুওয়াতের কোন নির্ভরযোগ্যতাই থাকবে না। আর তিনি যদি নিজ সন্তান-সন্ততি এবং আপনজনদের সাথে নিয়ে মুবাহালা করতে আসেন এবং সব ধরনের বস্তুগত ও পার্থিব জৌলুস থেকে মুক্ত হয়ে এক বিশেষ অবস্থায় মহান আল্লাহর দরগাহে প্রার্থনার জন্য হাত তোলেন, তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তিনি কেবল নিজেকেই সম্ভাব্য যে কোন ধ্বংসের মুখোমুখি করতে প্রস্তুত নন, বরং তিনি তাঁর সবচেয়ে সম্মানিত (ও প্রিয় আপন) ব্যক্তিদেরকেও ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।
নাজরানের প্রতিনিধি দল যখন দেখতে পেল যে, মহানবী (সা.) নিজের সাথে তাঁর কলিজার টুকরা নিষ্পাপ আপনজনদের এবং নিজের একমাত্র কন্যা সন্তানকে মুবাহালার ময়দানে নিয়ে এসেছেন তখন তারা মহা-বিস্ময়ে হতবিহবল হয়ে নিজেদের হাতের আঙ্গুল কামড়াতে লাগল। তারা স্পষ্ট বুঝতে পারল যে, মহানবী (সা.) তাঁর আহ্বান ও দুআর ব্যাপারে দৃঢ় আস্থাশীল। আর তা না হলে একজন দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের আপনজনদেরকে কখনোই আসমানী বালা-মুসিবত এবং মহান আল্লাহর শক্তি ও গজবের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না।
নাজরানের প্রধান ধর্মযাজক তখন বললেন: আমি এমন সব পবিত্র মুখমণ্ডল দেখতে পাচ্ছি যে, যখনই তাঁরা হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে সবচেয়ে বড় পাহাড়কে উপড়ে ফেলার জন্য দুআ করবেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের দোয়ায় সাড়া (জবাব) দেয়া হবে। সুতরাং এসব আলোকিত (নূরানী) মুখমণ্ডল এবং সুমহান মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির সাথে আমাদের মুবাহালা করা কখনও ঠিক হবে না। কারণ এতে করে আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয় এবং স্রষ্টার শাস্তি ব্যাপকতা লাভ করে বিশ্বের সব খ্রীস্টানকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারে। তখন পৃথিবীর বুকে একজন খ্রীষ্টানও আর থাকবে না।
নাজরানের প্রতিনিধি দল পরস্পর পরামর্শ করে সম্মিলিতভাবে মুবাহালায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর তারা জিযিয়া কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ভিত্তিতে মহানবীর (সা.) সাথে সন্ধিচুক্তি করে। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মহানবী (সা.) বলেন: মহান আল্লাহর শাস্তি নাজরানবাসীদের মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করেছিল। আর তারা যদি মুবাহালা ও পারস্পরিক অভিসম্পাত (মুলাআনাহ) প্রদানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত, তাহলে তারা তাদের মনুষ্যাকৃতি হারিয়ে ফেলত এবং মরু-প্রান্তরে যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় তাতে তারা দগ্ধ হতো। আর খোদায়ি শাস্তিও নাজরান অঞ্চলকে গ্রাস করত এমনকি উক্ত অঞ্চলের গাছ-পালায় বিদ্যমান পাখীগুলোও মারা যেত। (দ্র. আয়াতুল্লাহ জাফার সুবহানী প্রণীত ‘চিরভাস্বর মহানবী (সা.)’, খ: ২, পৃ়: ৩৬৮-৩৭০ এবং আল্লামাহ জারুল্লাহ যামাখশারী প্রণীত তাফসীর আল-কাশশাফ, পৃ: ১৭৫, ২য় সংস্করণ, ২০০৫, দারুল মারেফাহ, বৈরুত, লেবানন)
মুবাহালার মহাঘটনা মহানবীর (সা.) আহলুল বাইতের (আ:) পরিচয় সুস্পষ্ট করে দেয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে মহানবীর (সা.) আহলুল বাইত হচ্ছেন হাতে গোণা নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি যাঁরা হচ্ছেন সুরা-ই আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে উল্লিখিত ‘আহলুল বাইত’। এই মহান ব্যক্তিদেরকে মহান আল্লাহ পাক সব পাপ-পঙ্কিলতা (রিজস) থেকে পুরোপুরি পবিত্র করার ইচ্ছা করেন। আর এ আয়াতের শানে নুযূলে নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাহ এবং আরও কতিপয় সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস-ই কিসা (চাদরের হাদীস) অনুসারে উক্ত আয়াতে উল্লেখিত মহানবীর (সা.) পবিত্র আহলুল বাইত যে হযরত ফাতিমা (আ.), হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.) তা সুস্পষ্ট এবং অন্যরা এমনকি নবী-পত্নীগণও যে আহলুল বাইতের অন্তর্ভুক্ত নন তাও প্রমাণ হয়।
মহানবীর (সা.) স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবুবকর থেকে বর্ণিত হয়েছে: মুবাহালার দিবসে কালো পশমের একটি চাদর দিয়ে দেহ আবৃত করে মহানবী (সা.)বের হলেন , এরপর হাসান আসলে তাঁকে উক্ত চাদব়ে প্রবেশ করালেন, এরপর হুসাইন এলে তাঁকেও ঐ চাদব়ে প্রবেশ করালেন, এরপর ফাতিমা এলে তাঁকেও এবং এরপর আলী এলে তাঁকেও ঐ চাদরে প্রবেশ করালেন। এরপর তিনি ( সা.) এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন:
হে আহলুল বাইত! নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে সব ধরনের পাপ–পঙ্কিলতা দূর করতে এবং পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। (সুরা-ই আহযাব: ৩৩) (দ্র: আল্লামাহ জারুল্লাহ যামাখশারী প্রণীত তাফসীর আল-কাশশাফ, পৃ: ১৭৫, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৫, দারুল মারেফাহ, বৈরুত, লেবানন এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৬২৮৮, পৃ: ৯১৫, দার সাদির, বৈরুত, লেবানন, ১ম সংস্করণ, ২০০৪ ) ….চলবে….
লেখা : মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান