হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম হুসাইন (আ.) শাহাদাতের চেহলাম বার্ষিকী বা আরবাইন কী এবং এর ঐতিহাসিক ভিত্তি কী? এ সম্পর্কে জনাব মোহাম্মাদ মুনীর হুসাইন বলেন, প্রথমে আরবাইন কী সে সম্পর্কে বলছি। আরবাইন ( اربعین)বা আরবাঊন(اربعون) আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে চল্লিশ বা চল্লিশতম। আল-ইয়াওমুল আরবাঊন বা আল-ইয়াওমিল আরবাঈন হচ্ছে চল্লিশতম দিন। বাংলাদেশে মৃত্যুর পর চল্লিশতম দিবসে মৃত ব্যক্তির স্মরণে যে ইসালে সওয়াব ও দুয়ার অনুষ্ঠান করা হয় তাকে চল্লিশা বা চেহলাম (ফার্সী শব্দ) বলা হয়ে থাকে।
আর ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় ১০ মুহাররম অর্থাৎ আশুরার দিনে শাহাদাত বরণের পর চল্লিশতম দিন অর্থাৎ ২০ সফরকে আরবাইন বলা হয়। আর এ দিনে ইমাম হুসাইন এবং তার সঙ্গীসাথিদের স্মরণে শোকানুষ্ঠান বা আযাদারি পালন ও জিয়ারত করা হয়। আর এ জিয়ারত হচ্ছে মুস্তাহাব।
২০ সফর অর্থাৎ ইমাম হুসাইন(আ.)’র আরবাইন উপলক্ষে জিয়ারত ও দুআগুলো বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদিস ও দুআর গ্রন্থ যেমনঃ শেখ তূসী প্রণীত তাহযীবুত তাহযীব ও মিসবাহুল মুতাহাজ্জিদ এবং শেখ আব্বাস কোমী প্রণীত মাফাতীহুল জিনান ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে। ইমাম হুসাইন(আ.)’র আরবাইনসহ সকল জিয়ারতে যেসব দুআ তথা মহানবী(সা.),হযরত ফাতেমা(সা.আ.),হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান এবং আহলে বাইত(আ.)’র অন্য সকল ইমাম(আ’)র জিয়ারতে যেসব দুআ পড়া হয় তার অন্তর্নিহিত অর্থ অত্যন্ত উচুঁ মানের একইসাথে উচুঁ পর্যায়ের মারেফাত ও তাত্ত্বিক ইসলামী জ্ঞানে পরিপূর্ণ।
ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসলে ইসলামী তাত্ত্বিক জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও মারেফাতের ভাণ্ডার হচ্ছে এ সব দুআ ও জিয়ারতনামা।আমরা সংক্ষেপে ইমাম হুসাইন(আ.)র আরবাইনের জিয়ারতের দুয়ার মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করছিঃ প্রথমত: ইমাম হুসাইনের উপর সালাম দেয়া হয়েছে। এরপর তাঁর পরিচিতি এবং তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা,আল্লাহর রাহে তাঁর জিহাদ,ধৈর্য-সবর ও শাহাদাত বরণের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যে তাঁর মাতামহ হযরত রাসূলুল্লাহ(সা.)এর উম্মতকে বিচ্যুতি ও গোমরাহী থেকে রক্ষা করা। এসব বিষয় এতে বর্ণিত হয়েছে।
এরপর ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীদের উপর লানৎ দেয়া হয়েছে।তারপর তাঁর আধ্যাত্মিক মাকাম এবং তাঁর সকল কর্মকাণ্ড ও গোটা জীবন যে সুমহান ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তিনি যে মহান আল্লাহ পাকের ঐশী প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন, আল্লাহর রাহে জিহাদ করে মজলুমভাবে শহীদ হয়েছেন এ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে।
তারপর মহানবী(সা.)এর সুন্নাহ অনুসরণ করে ইমাম হুসাইনের মুহাব্বতকারী ও অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন এবং তাঁর শত্রু ও হত্যাকারীদের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা প্রদর্শনের কথা বর্ণিত হয়েছে।
এরপর তাঁর ইমামতের ব্যাপারে সাক্ষ্যদান এবং তাঁর প্রতি জিয়ারতকারীর আনুগত্য এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য জিয়ারতকারীর সদাপ্রস্তুত থাকার ব্যপারেও সাক্ষ্যদান করা হয়েছে, যাতে করে আল্লাহ পাক যেন তাকে অর্থাৎ জিয়ারতকারীকে এ দুনিয়া ও আখেরাতে ইমাম হুসাইন(আ.)এর সাথে রাখেন। ইমাম হুসাইন ও আহলুল বাইতের শত্রুদের সাথে নয় এবং শেষে ইমাম হুসাইন(আ.)ও আহলে বাইত এর উপর দরুদ প্রেরণ করা হয়েছে।
আরবাইনের ঐতিহাসিক ভিত্তি ও প্রেক্ষাপট :
মশহুর (প্রসিদ্ধ) অভিমত হচ্ছে যে ২০ সফর ৬১ সালে বন্দিত্বদশা থেকে মুক্তি পাবার পর দামেস্ক খেকে মদীনা প্রত্যাবর্তনকালে ইমাম জয়নুল আবেদীন(আ.) এবং আহলে বাইত(আ.)র কাফেলা কারবালা আগমন করেন এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন(আ.)শহীদদের নেতা মজলুম ইমাম হুসাইন(আ.)’র কাটা মাথা কবরে শুইয়ে দিয়ে তাঁর দেহের সাথে যুক্ত করে দাফন করেন।
সেখানে তারা ৩ দিন অবস্থান করে শহীদদের নেতা এবং তাঁর শহীদ সাথীদের জন্য আজাদাারি করেন।
আবার তাবেয়ী আতা থেকে বর্ণিত আছে-আমি (রাসুলুল্লাহর সাহাবী জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আনসারীর সাথে (হিজরী ৬১সালের) ২০ সফর গাযেরিয়ায় (কারবালা) পৌঁছাই। জাবির(রা.)ফুরাত নদীতে গোসল করে পবিত্র একটি পোশাক পরেন। এরপর তিনি বলেন- আতা তোমার সাথে সুগন্ধি কিছু আছে কি । আতা বললেন আমার সাথে কিছু সুউদ (এক ধরণের সুগন্ধি)আছে। তখন তিনি তা থেকে কিছু নিয়ে মাথা ও গায়ে মাখেন এবং খালি পায়ে ইমাম হুসাইন(আ.)এর কবর জিয়ারত করতে গেলেন।
কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ৩ বার আল্লাহু আকবর বলেন এবং এরপর তিনি মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তাকে আমি বলতে শুনলাম-‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আলাল্লাহ’ অর্থাৎ ১৫ রজবে যে জিয়ারতনামা পড়া হয় সেটার মতোই(দ্রঃ মাফাতীহুল জিনান,পৃঃ৮৫৮)।
আর এটাই হচ্ছে ইমাম হুসাইন(আ.)’র আরবাইনের(চেহলাম)প্রথম জিয়ারত।এরপর থেকে এ জিয়ারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান বিশেষ করে ইরাকে।