۲ آذر ۱۴۰۳ |۲۰ جمادی‌الاول ۱۴۴۶ | Nov 22, 2024
z
হজরত যয়নাবের (সা.আ.) গৌরবময় অবদান

হাওজা / পিতার মতই অনলবর্ষী বক্তা ও বাগ্মী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন হযরত যয়নাব (সা.আ.)।

হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ও নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.আ.)'র কন্যা হযরত যয়নাব (সা.আ.) ইসলামের ইতিহাসে যে গৌরবময় অবদান রেখেছেন তা তাঁর ভাই হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)'র মহাবিপ্লবেরই ধারাবাহিকতার সূত্রে একসঙ্গে গাঁথা। তাই ভাইয়ের বীরত্বগাঁথার পাশেই স্থান পেয়েছে যয়নাব (সা.আ.)'র অনন্য কীর্তিগাথা। তবে যে দিকটি বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের প্রেমিকদের যয়নাব (সা.আ.)'র জন্য বিশেষভাবে বেদনায় আকুল করে তা হল, রাসূল (সা.)'র আহলে বাইতের শীর্ষ চার সদস্যের তথা বাবা-মা ও দুই ভাই ও তাঁদের পরিবারের একান্ত আপনজনদের অতুলনীয় ব্যাথা-বেদনার সাথী হয়েছিলেন এই ক্ষণজন্মা নারী। তাঁদের অশেষ মজলুমিয়াত বা অসহায়ত্ব ও অপরিসীম বঞ্চনার দৃশ্যগুলোসহ তাঁদেরকে অকালে হারানোর অসহনীয় বেদনার ভাই বইতে হয়েছিল একা এই মহিয়সী নারীকেই।

হযরত যয়নাব (সা.আ.) ইন্তিকাল করেছিলেন হিজরি ৬২ সনের ১৫ ই রজব। কারবালার মহাবিপ্লব যয়নাবকে ছাড়া কেবলই যে অপূর্ণ থাকত তা নয়, এ বিপ্লবের বার্তা ও প্রকৃত ইতিহাসও চিরতরে হারিয়ে যেত। সফল হত তারাই যারা প্রকৃত মুহাম্মদী ইসলাম ও এর প্রকৃত নায়কদের বিস্মৃতির অতলগর্ভে তলিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল।

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাদ ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত দিনগুলোতে ও বিশেষ করে আশুরার অপরাহ্নেও অশেষ ধৈর্য নিয়ে খোদায়ি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, কিংবা আশুরার বিপ্লবের পরও জালিম শাসকের সামনে নির্ভিক চিত্তে সত্যের সুরক্ষা ও আহলে বাইতের মহত্ত্ব আর অসহায়ত্ব তুলে ধরার জন্য যয়নাব (সা.আ.)'র পবিত্র নাম প্রজ্জ্বোল তারকার মতই চির-অম্লান হয়ে আছে।

বহু মহতী গুণের ক্ষেত্রে যেমন, নেতা বা ইমামদের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসায়, এবাদতে, প্রজ্ঞায় ও জ্ঞানে, খোদাভীরুতায় ও সতীত্বে এবং সত্যের পক্ষে নির্ভিকতায় ও বাগ্মীতায় কেবল রমনীকুলের জন্যই নয়, অন্য সব মানুষের জন্যেও যয়নাব (সা.আ.) অনুকরণীয় আদর্শ। বিনয় ও নম্রতা, সত্যবাদীতা ও ভদ্রতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। যে কোনো বিপদের সময় অন্যদের জীবন রক্ষার জন্য নিজ জীবনকে বিপন্ন করা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতি। পিপাসায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কারবালায় নিজের অংশের পানিটুকু দান করেছিলেন শিশুদেরকে। কারাবালার সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও অশেষ ধৈর্য নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবিচল ছিলেন এই সাহসী নারী। অথচ এমন কঠিন সংকটের চেয়ে হাজার গুণ ক্ষুদ্র সংকটের সময়ও ভগ্ন-হৃদয় হয়ে যায় নারী-পুরুষ। যয়নাব (সা.আ.) কারবালায় কখনও কখনও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন শত্রুদের সুপথের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে। আবার কখনও সেই কঠিন সংকটের শিকার ও বিপদাপন্ন মুমিনদের সান্তনা দিয়েছেন। কখনও ব্যস্ত থেকেছেন পরবর্তী ইমাম ও রাসূলের আহলে বাইতের শেষ বাতি তথা ইমাম হোসাইন (আ.)'র পুত্র ইমাম যেইনুল আবেদীন (আ.)-কে রক্ষার কাজে।

কারবালা বিপ্লবের আশুরা-পরবর্তী অধ্যায় পরিচালনা করেছেন হযরত যয়নাব (সা.আ.)। কারবালা থেকে কুফায় ও সিরিয়া যাওয়ার পথে সেযুগের জালেম শাসকদের সামনে ও জনগণের সামনে যেসব ভাষণ ও বক্তব্য রেখেছিলেন আলী-দুহিতা যয়নাব (সা.আ.) সেগুলো তাঁর উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মহত্ত্বসহ আরো কিছু অসাধারণ গুণ তুলে ধরেছে। সময়-উপযোগী নানা সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সময় বা উপলক্ষে। তিনি জানতেন কোথায় শান্তভাবে বক্তব্য রাখতে হবে এবং কোথায় বীরত্বব্যাঞ্জক বা জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখতে হবে। এবারে যয়নাব (সা.আ.)'র ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর কিছু অংশ উদ্বৃত ও পর্যালোচনা করব যেসব ভাষণে ফুটে উঠেছে তাঁর অতুল মহত্ত্ব, দৃঢ় ঈমান ও শক্তিশালী ইসলামী চিন্তা-চেতনা ।

হযরত যয়নাব (সা.আ.) এমন সময় কারবালা থেকে ফিরে এসে কুফায় ও সিরিয়ায় যথাক্রমে অভিশপ্ত ইবনে জিয়াদ ও ইয়াজিদের দরবারে এইসব ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছিলেন যখন বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত চরম রাজনৈতিক সংকট ও চাপের মুখে ছিলেন। সে সময় নিরাপত্তার কঠোরতম ব্যবস্থা নিয়েছিল জালিম ইয়াজিদ চক্র। ইমাম পরিবারের ওপর বাহ্যিক বিজয়ের উম্মাদনায় এই জালেম শাসকগোষ্ঠী নবী(সা.)-বংশকে অবমাননার প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু যয়নাব (সা.আ.)'র বলিষ্ঠ ও নির্ভিক ভাষণগুলো জালেম শাসকদের ময়দানকে সংকীর্ণ করে দেয় এবং তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায় গণ-বিপ্লবের ভয়ে। এসব ভাষণ থেকে বোঝা যায় এতসব অবর্ণনীয় বিপদ ও কষ্ট সত্ত্বেও নবী-নাতনি যয়নাব (সা.আ.)'র মনোবলে কোনো ঘাটতি ছিল না। মুমিন যে শত বিপদেও প্রসন্ন চিত্ত নিয়ে ইসলামের নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করে যান ফাতিমার কন্যা ছিলেন তার প্রজ্জ্বোল দৃষ্টান্ত।

কুফায় ও সিরিয়ায় হযরত যয়নাব (সা.আ.)'র বলিষ্ঠ ও নির্ভিক ভাষণগুলো ধর্মীয় জ্ঞানের সমৃদ্ধ উৎসে পরিণত হয়েছে। সেইসব ভাষণ সে যুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এবং বিশেষ করে খলিফা নামধারী শাসকদের তাগুতি প্রকৃতি প্রকাশের প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। রাসূল (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের বক্তৃতা ও ভাষণের ধারা হল, তাঁরা মহান আল্লাহর এমন উচ্চ মানের প্রশংসা কীর্তণ করেন যা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি তাঁদের সন্তুষ্টি ও খোদাপ্রেমের অশেষ গভীরতাই তুলে ধরে। এসব ভাষণে তারা মহান আল্লাহর নেয়ামতের তুলনায় অসহনীয় বিপদ-মুসিবতকেও খুবই তুচ্ছ বা নগণ্য জ্ঞান করেন। আহলে বাইতের সন্তান যয়নাব (সা.আ.) ভাষণগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। ইবনে জিয়াদ যখন পরিহাস করে প্রশ্ন করে যে, তোমার ভাই হোসাইনের ব্যাপারে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে? যয়নাব (সা.আ.) খোদাপ্রেমে পরিপূর্ণ হৃদয়ে বলেছিলেন, "আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখিনি, আল্লাহ চেয়েছিলেন যে তাঁরা শহীদ হবেন, তাঁরা তাঁদের চির-বিশ্রামস্থলে ছুটে গেছেন, আল্লাহ শিগগিরই তোমাকে ও তাঁদেরকে পুনরুত্থিত করবেন, সেদিন তুমি দেখবে যে কে প্রকৃত বিজয়ী হয়েছে।"

মহান আল্লাহর সাহায্যের প্রতি অবিচল আস্থা থেকেই উৎসারিত হয় এমন বাক্য, যা শত্রুর জন্য অপমানের উৎস। মুসলিম সমাজের নেতা বা ইমাম হিসেবে ভাইয়ের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে যয়নাব (সা.আ.) বলেছেন, "কিভাবে রাসূলেরসা. সন্তান ও বেহেশতী যুবকদের নেতাকে হত্যার কলঙ্ক বহন করবে, এ কলঙ্ক এমন এক মহান ব্যক্তিকে হত্যার কলঙ্ক যিনি ছিলেন তোমাদের জন্য আশ্রয়-স্থল, শান্তি, শৃঙ্খলা ও ঐক্যের সংরক্ষক এবং ছিলেন তোমাদের ধর্মের পথ-প্রদর্শক। " এরপর তিনি সুরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, "মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি আমাদেরকে রাসূল (সা.)'র মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন এবং আমাদেরকে সব ধরণের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। "

এরপর যয়নাব (সা.আ.) সুরা আলে ইমরানের ১৭৮ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করেন। যেখানে বলা হয়েছে, "কাফেররা যেন মনে না করে যে আমি যে, অবকাশ দান করি, তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর। আমি তো তাদেরকে অবকাশ দেই যাতে করে তারা পাপে উন্নতি লাভ করতে পারে। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাজনক শাস্তি।"

যয়নাব (সা.আ.) তাঁর ভাষণে অভিশপ্ত ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেছেন, খোদায়ী বিধান ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে তোমার এসব কাজ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিদ্রোহ এবং রাসূলের নবুওয়্যাত ও কোরআনের বিধানকে অস্বীকারের সমতুল্য। তিনি ইয়াজিদকে উদ্দেশ করে আরও বলেছিলেন, "নানা মুসিবত ও চাপের মুখে তোমার সাথে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, কারণ, তোমার এমন যোগ্যতা নেই যে আমরা তোমার সাথে কথা বলব। এই পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তোমার সম্পদ ও বিলাসী জীবন এতেই সীমিত। আমাদের মুসিবত এই পার্থিব জগতেই শেষ হবে, কিন্তু আমরাই বিজয়ী, কারণ, সত্য আমাদের পক্ষে।"

এভাবে পিতার মতই অনলবর্ষী বক্তা ও বাগ্মী হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন হযরত যয়নাব (সা.আ.)।

تبصرہ ارسال

You are replying to: .