ড. মাওলানা এ.কে.এম. মাহবুবুর রহমান
হাওজা নিউজ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, হযরত আলী কারামুল্লাহু ওয়াজহু ঐ সন্তান, পবিত্র কাবা যাঁর জন্মস্থান; ঐ শিশু সর্বপ্রথম প্রিয় নবীর কোলে পেয়েছেন স্থান, যাঁর কপালে লেগেছে দয়াল নবীর মায়ার চুমু, ঈমানের দাওয়াত পেয়ে যিনি সর্বপ্রথম বলেছেন : ‘লাব্বাইক’; সুখে-দুঃখে, ঘরে-বাইরে, সফরে, যুদ্ধের ময়দানে যিনি ছিলেন রাহমাতুল লিল আলামীনের সাথে ছায়ার মতো। اشداء على الكفار رحماء بينهم ‘কাফেরদের সাথে খড়গহস্ত, মুমিনের জন্য দয়ার সাগর’- কুরআন মাজীদের এ গুণের যিনি ছিলেন মূর্ত প্রতীক। যাঁর কথা ছিল মনকাড়া, যার চাহনি সাড়া জাগাতো হৃদয়ে, যাঁর হাসি ছিল মুক্তঝরা, দান ছিল মুষলধারা বৃষ্টির মতো, যাঁর নামায ছিল মিরাজ, যিনি ছিলেন বীরত্বের প্রতীক, কামুছ দুর্গের বিশাল কপাট ছিল যাঁর যুদ্ধের ঢাল, লকব ছিল ‘হায়দারে কাররার’, যাঁর হাতে ছিল জুলফিকার।
জ্ঞানে-বিজ্ঞানে যিনি ছিলেন মদীনাতুল ইল্ম তথা ইলমের শহরের দরজা। জ্ঞানের শহর, মানবতার শিক্ষক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাঁর শানে ইরশাদ করেছেন :انا مدينة العلم وعلى بابها ‘আমি ইলমের শহর আর আলী তার দরজা।’ তাই তো তিনি শরীয়ত, তরীকত, হাকিকত, মারেফতের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। হযরত আলী ছিলেন পূতঃপবিত্র। নিষ্কলুষ জীবনের অধিকারী আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য। যাঁদের শানে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন :إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূতঃপবিত্র রাখতে।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)
হযরত ওমর বিন আবি সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যখন উক্ত আয়াত নাযিল হলো তখন আল্লাহর রাসূল হযরত উম্মে সালামার ঘরে অবস্থান করছিলেন। তিনি হযরত ফাতেমা, হাসান, হোসাইনকে সে ঘরে ডেকে নিয়ে একটি চাদরের নিচে ঢুকিয়ে নিলেন। হযরত আলী (কা.) রাসূলের পশ্চাতে ছিলেন। তাঁকেও ডেকে নিয়ে চাদরের নিচে ঢুকিয়ে দোয়া করলেন :
اللهُمَّ هؤلاء أهل بيتي فاذهب عنهم الرجس وطهرهم تطهيرا
‘হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বাইত; তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে নিন এবং তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করে দিন।’ (তিরমিযী-৫/৩৫১)
আহলে বাইতের দেদীপ্যমান সূর্য হযরত আলী ছিলেন কুরআন মাজীদ ব্যাখ্যায় সবার শীর্ষে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কুরআন মাজীদের প্রতিটি আয়াতের ৪০ ধরনের তাফসীর জানতেন। আর হযরত আলী (কা.) ৬০ ধরনের তাফসীর পেশ করতে সক্ষম ছিলেন। (তাফসীরে কাশফুল আসার, খাজা আবদুল্লাহ আনসারী) এতে বোঝা যায়, তিনি কুরআনের ব্যাখ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেই বলেছেন :
والله ما نزلت اية الا وقد علمت فيها نزلت و اين نزلت ان ربى وهب لى قلبا عقولا و لسانا سئولا-
‘আল্লাহর শপথ, কুরআন মাজীদের এমন কোন আয়াত নাযিল হয় নি যা আমার জানা নেই যে, কোন বিষয়ে নাযিল হয়েছে এবং কোথায় নাযিল হয়েছে। নিশ্চয়ই আমার রব আমাকে একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ অন্তর ও জিজ্ঞাসু যবান দান করেছেন।’ (আনসাবুল আশরাফ, বালাজুরী ২/৯৯)
কুরআন মাজীদের সঠিক ব্যাখ্যা, গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দ্বীনের আরকান তথা ঈমান, ইসলাম ও ইহসান সম্পর্কে জানতে হলে, শরীয়ত, তরীকত, হাকিকত ও মারেফাতের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হলে হযরত আলী (কা.)-এর জীবনকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সমৃদ্ধি, প্রগতি, উন্নতি সাধন করতে হলে প্রয়োজন প্রতি ক্ষেত্রে তাকওয়ার অনুশীলন। আল্লাহর ওপর যথাযথ ঈমান, র্শিকমুক্ত ইবাদত, আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রতি নিঃস্বার্থ মুহব্বত, আল্লাহর ভয় মনমুকুরে সদা জাগ্রত রাখার জন্য প্রয়োজন আখেরাতের শাস্তির ভয় মনে সদা জাগরুক রাখা। হযরত আলী (রা.)-এর প্রতিটি ভাষণ, কর্মতৎপরতায় তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর ও মাকাম ছিল সুস্পষ্ট। তিনি বিশ্বমানবতার উদ্দেশে বলেন :
عباد الله، زنوا انفسكم من قبل ان توزنوا ، وحاسبواها من قبل ان تحاسبوا – و تنفّسوا قبل ضيق الخناق – وانقادوا قبل عنف السياق ، واعلموا انه من لم يُعن على نفسه حتى يكون له منها واعظ و زاجر لم يكن له من غيرها زجر ولا واعظ.
‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমাদের পরিমাপ করার আগে তোমরা নিজেরাই নিজেদের পরিমাপ কর, তোমাদের হিসাব নেয়ার আগে নিজেরাই নিজেদের হিসাব নাও, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার আগেই নিজেরাই শ্বাস নাও, কঠোরতার সম্মুখীন হওয়ার আগেই নিজেরাই সমর্পিত হয়ে যাও এবং জেনে রেখ, যে ব্যক্তি নিজেই নিজেই উপদেশ দাতা ও সতর্ককারী রূপে নিজেকে সাহায্য করে না, তার জন্য অন্য কেউ সতর্ককারী বা পরামর্শদাতা হয় না।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা নং-৮৯)
মানুষের ধ্বংস কেন আসে, কিভাবে মানুষ মানবতা হারিয়ে পশুত্বের দিকে ধাবিত হয় তার বর্ণনা দিয়ে হযরত আলী (কা.) বলেন : ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুর নাম কলব বা অন্তর।’
‘কলবে যদি কোন আশার সঞ্চার হয়, লোভ এসে তাকে অপদস্থ করে। লোভ যদি তার ওপর আক্রমণ করে, মোহ তাকে ধ্বংস করে। নিরাশা যদি তাকে পেয়ে বসে তা হলে আফসোস তাকে ধ্বংস করে। তার ওপর যদি ক্রোধ প্রভাবশালী হয়, তাকে উত্তেজিত করে। আনন্দের সৌভাগ্য যদি তার ভাগ্যে জোটে, তা হলে সংযমের লাগাম হাতছাড়া হয়ে যায়। ভয় যদি পেয়ে বসে তা হলে আতঙ্ক তাকে ব্যস্ত করে রাখে। তার কাজে যদি প্রশস্ততা দেখা দেয়, তবে অবহেলা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। যদি সম্পদ তার হস্তগত হয়, ধনাঢ্যতা তাকে অবাধ্যতায় বাধ্য করে। যদি কোন দুঃখ-মুসিবতে পতিত হয়, অধৈর্য তাকে অপমানিত করে। যদি সে দারিদ্র্যে পতিত হয়, বালা-মুসিবতে বন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষুধা যদি তাকে শক্তিহীন করে, দুর্বলতায় সে অচল হয়ে পড়ে। যদি উদর পূর্তি হয়ে যায়, উদরপূর্তি তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কাজেই প্রত্যেক দোষ ও গুনাহর মাঝে ক্ষতি আছে এবং যে কোন সীমা অতিক্রম করা হলে তার পরিণামে ধ্বংস অনিবার্য।’ (নাহজুন বালাগা খুতবা-১০৫)
সমাজের বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হলো অসৎ নেতৃত্ব। সৎ কাজের আদেশ দান ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা সমাজের নেতৃত্বের ওপর ফরয দায়িত্ব। যারা সৎকাজের আদেশ দান করে নিজেরা করে না তাদের সম্পর্কে হযরত আলী (কা.) বলেন :
لعن الله الآمرين بالمعروف التاركين له – والناهين عن المنكر العاملين به-
‘যারা অন্যকে সৎকাজের উপদেশ দেয় অথচ নিজে তা বর্জন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে আর নিজেরা তাতে প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি লানত বর্ষণ করেছেন।’ (প্রাগুক্ত, খুতবা-১২৯)
যালিম শাসকের সামনে ন্যায় কথা বলা সবচেয়ে বড় জিহাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
وافضل من ذالك كله كلمه عدل عند امام جائر
‘সবকিছু থেকে উত্তম হচ্ছে কোন যালিম শাসকের সামনে ন্যায় কথা বলা।’ (নাহজুল বালাগা পরিচিতি, পৃ. ২৬২)
হযরত আলী (কা.) ছিলেন মহান দার্শনিক। তাঁর প্রতিটি কথা ও বাণী দর্শনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চূড়ান্ত বক্তব্য। ঈমান ও ইবাদতের দর্শন এবং একটি সন্ত্রাসমুক্ত নিষ্কলুষ সমাজ বিনির্মাণের জন্য যে মূলনীতি প্রয়োজন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘আল্লাহ ঈমানকে ফরয করেছেন র্শিক থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য, নামায ফরয করেছেন গর্ব অহংকার থেকে মুক্ত করার জন্য, যাকাত ফরয করেছেন রিয্ক পৌঁছানোর মাধ্যমে হিসেবে, রোযা ফরয করেছেন বান্দাদের একনিষ্ঠতা যাচাই করার জন্য, হজ ফরয করেছেন দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার জন্য, জিহাদ ফরয করেছেন ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত করার জন্য, সৎ কাজের আদেশ দান ফরয করেছেন সর্বসাধারণের কল্যাণ সাধনের জন্য, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন মূর্খদের শাসানোর জন্য, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ফরয করেছেন সহানুভূতিশীল লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, কিসাস বিধিবদ্ধ করেছেন রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, দণ্ডবিধি প্রয়োগের বিধান দিয়েছেন সম্মানীদের সম্মান রক্ষার জন্য, মদপান হারাম করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধিকে নিষ্কলুষ রাখার জন্য, চুরি থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন পূতঃপবিত্রতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য, যেনা-ব্যভিচার ত্যাগের বিধান দিয়েছেন যেন বংশধারা কলুষিত না হয়। সমকামিতা নিষেধ করেছেন যাতে সন্তান-সন্ততি অধিক হয়, সাক্ষ্য দান ফরয করেছেন যেন হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার হয়, মিথ্যা বলা নিষেধ করেছেন যেন সত্য সমুন্নত হয়, সালাম বিনিময়কে বিধিবদ্ধ করেছেন ভীতিপ্রদ অবস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য, আমানত রক্ষার বিধান দিয়েছেন উম্মতের কার্যাদির সুব্যবস্থার জন্য, আনুগত্যকে ফরয করেছেন নেতৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হিসেবে।’ (নাজহুল বা লাগা ভাষণ নং ২৪৪)
হযরত আলী (কা.) জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন :من علمنى حرفا صيرنى عبدًا ‘যে আমাকে একটি হরফ শেখালো সে আমাকে তার অনুগত দাসে পরিণত করল।’ (আখলাক, ফয়েজ কাশানী)
আদালত, ইনসাফের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার মূর্ত প্রতীক ছিলেন হযরত আলী (কা.)। ৩৬ হিজরির ২৫শে যিলহজ শুক্রবার খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে সর্বপ্রথম যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে গ্রহণীয় বর্জনীয় বিষয় অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন :
إن الله عز و جل أنزل كتاب هاديا بين فيه الخير والشر فخذوا بالخير و دعوا الشر- الفوائض ادواها الى الله سبحانه و تعالى يودكم الى الجنة
‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ কিতাব নাযিল করেছেন হেদায়াতের মশাল হিসেবে, তাতে কল্যাণ ও অকল্যাণের বর্ণনা দিয়েছেন। তাই আপনারা কল্যাণকে আঁকড়ে ধরুন আর অনিষ্ট ও অকল্যাণকে পরিহার করুন। দায়িত্ব পালন করুন, তাতে আল্লাহ আপনাদেরকে জান্নাত দেবেন।’
একটি রাষ্ট্রের সরকার ও সমাজ গঠনের শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতি কী হবে, অত্যাচারী শাসনাধীনে নিষ্পেষিত জনতার মৌলিক দাবী কী হবে, সুশাসন ও কুশাসন এবং ন্যায় ও যুলুমের মধ্যে পার্থক্য করার কষ্টি পাথর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে অঙ্কিত রয়েছে মিশরের গভর্নর মালিক আশতারের নামে লেখা দীর্ঘ পত্র- যা বিশ্বমানবতার বিশেষ করে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন ও আসবেন সকলের জন্য এক কালোত্তীর্ণ, শ্বাশত সর্বাধুনিক সংবিধান। মালেক আশতারের উদ্দেশে তিনি লেখেন : ‘আমি তোমাকে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ প্রদান করছি, জীবনের সর্ববিধ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর প্রদত্ত ব্যবস্থাকে সবার ওপরে স্থান দেবে। তাঁর স্মরণ ও ইবাদতকে অগ্রাধিকার দান করবে, কোরআনের নির্দেশ ও মহানবী (সা.) এর শিক্ষাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করবে।’
‘আমি তোমাকে আদেশ করছি মালিক, তোমার মন-মগজ, হাত ও কণ্ঠ এবং তোমার সমগ্র সত্তা দিয়ে আল্লাহকে তাঁর উদ্দেশ্য ও সৃষ্টিকে সহায়তা করতে।… মনে রেখ যে, ক্ষমতাসীন লোকদের কৃতকর্মের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী বংশধররা তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিচার করে থাকে। মনে রেখ, নিজের প্রতি সুবিচার করার এবং ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং অসৎ বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করা। তোমার মনে জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সহায়তা লালন করতে হবে। হিংস্র পশুর মতো জনগণকে নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করার নেশা যেন তোমাকে পেয়ে না বসে। তোমার প্রতি আল্লাহর যে রকম দয়া ও সহানুভূতি আশা কর তাদের প্রতিও সেরূপ তুমি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল হও। ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করতে কখনো লজ্জা কিংবা বেদনা বোধ করো না, কাউকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা আছে বলে কখনো পুলকিত বা গর্ববোধ করো না। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, ক্ষমা করে দেয়ার অধিকার একজন শাসকের চেয়ে আর কার বেশি থাকতে পারে? অতএব, তুমি অবশ্যই কারো গোপন ভুল-ত্রুটিগুলো অনুসন্ধান করতে যাবে না। ওগুলো আল্লাহর জন্য রেখে দাও। যেসব ত্রুটি ও ব্যর্থতা তোমার নজরে আসে সেগুলোর ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব হচ্ছে, কী করে সেগুলো সংশোধন করতে হয় সে ব্যাপারে মানুষকে শিক্ষা দেয়া। কৃপণদের থেকে কখনো উপদেশ গ্রহণ করবে না, যারা তোমার মধ্যে দারিদ্র্যের ভীতি সৃষ্টি করবে। যারা মিথ্যা প্রশংসা করে আনুকূল্য চায় তাদের ত্যাগ কর। একজন শাসক জনগণের মধ্যে আনুগত্যও সৃষ্টি করতে পারে, শুধু যদি সে তাদের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিসম্পন্ন হয়, ক্রমাগত তাদের বোঝা হালকা করে দেয়, তাদের ক্ষমতার বাইরে কর বসানো পরিহার করে, তাদের ওপর যুলুম ও নিষ্পেষণ না চালায়, তাদের শক্তির বাইরে কোন দায়িত্ব চাপিয়ে না দেয়।’
হযরত আলীর এ ঐতিহাসিক চিঠিতে সেনাবাহিনীর মর্যাদা, দায়িত্ব, বিচারক, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও সচিবালয়ের নীতিমালা কী হবে, ব্যবসায়ী ও কারিগরদের অবস্থান কী, দরিদ্র পঙ্গুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কেমন হবে, সেনাপতি নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি কী, রাষ্ট্রের নেতা ও জনগণের পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব কী হবে, বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতি কেমন হবে, বিচারকবৃন্দের যোগ্যতা ও গুণাবলি কেমন হতে হবে, রাজস্ব বিভাগ কিভাবে চলবে, সচিব হওয়ার যোগ্যতা কারা রাখেন, সমাজের বঞ্চিত ও মুস্তাদআফীনের অধিকার কিভাবে সংরক্ষিত হবে, নেতৃত্বে স্বজনপ্রীতি রোধ কি করে করা যাবে, অভিযোগ খণ্ডনের পদ্ধতি কী হবে, নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনে কী কী বিষয় অনুসরণ করতে হবে- এককথায় একটি সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ, একটি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বাধুনিক মডেল উপস্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়াও নাহজুল বালাগায় বর্ণিত ভাষণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বিশ্বকোষ। যার শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রকে আলোকিত করতে গ্রহণযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করছে।
এ মহান ব্যক্তিত্বের ‘দিওয়ান’ বা কাব্যসম্ভার আরবি কাব্যসাহিত্যে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি যাতে মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের প্রচুর উপাদান রয়েছে। ইলমে তরীকতের ইতিহাসে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দাদিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়্যা, রেফাইয়্যা, জুনাইদিয়্যা, তাইফুরিয়্যা, পীর হাজাতিয়্যা, মওলাবিয়্যা তরীকাসহ শতাধিক তরীকার মূল সূত্র হলেন হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু ও তাঁর বংশধরগণ। অধুনা বিশ্বে মুসলমানদের বিপর্যয়ের কারণ হলো এ মহান ইমামগণের শিক্ষা, আধ্যাত্মিক আলো থেকে বিচ্যুতি, যাঁরা জীবনের সর্বত্র আল্লাহর রবুবিয়্যাত প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রাম করে মুসলিম মিল্লাতের হায়াতে তাইয়্যেবা তথা সুখী, সমৃদ্ধ, প্রগতিশীল, শ্বাশত, সর্বাধুনিক, পূতঃপবিত্র জীবন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। শের-ই-খোদার বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করেই মাথা দিয়েছেন আহলে বাইত- ইয়াযীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন নি। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.)-এর ভাষায়-
سرداد دست نداد بردست يزيد – حقاكه بناى لا اله است حسين-
‘মাথা দিয়েছেন, হাত দেননি ইয়াযীদের হাতে। সত্যিকারের তাওহীদের ভিত্তিই আর কেউ নয় ইমাম হোসাইন (আ.)।’
শুকনো রুটি কেবল পানি দিয়ে খেয়ে কষ্ট করে জীবন যাপন করা সত্ত্বেও হযরত আলী (কা.) বলতেন : ‘আমার ভয় হচ্ছে, হয়ত বা কোথাও কোন মানুষ অনাহারে রয়েছে। তাই বিংশ শতাব্দীর মুসলিম মিল্লাতের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) বলেছেন : ‘ন্যায় বিচার সত্যিকার অর্থে তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন আমার রাষ্ট্র ও জনগণের সাথে লেনদেন, আচার-বিচার ও আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে ইমাম আলীকে অনুসরণ করি এবং মালেক আশতার তথা সমস্ত শাসক ও প্রশাসকের প্রতি তাঁর নির্দেশমালা অনুসরণ করে চলি।’ (বেলায়েতে ফকীহ, পৃ. ৭৪)