(শহীদ তিতুমীর কারবালা ট্রাস্ট)
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আবিদা বানু বেগম ছিলেন ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলাদের মধ্যে অন্যতম ও ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী মুসলিম রমনীদের মধ্যে অন্যতম। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চরমপন্থীদের মধ্যে তিনি স্বাধীনতা চেতনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি "বাই–আম্মা" নামেও পরিচিত। আবিদা বেগম ১৮৫০ সালে উত্তরপ্রদেশের আমোরা গ্রামে মাওলানা মোজাফফর আলীর কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। মোজাফফর আলীর বড়ো ভাই সেসময়ে মোগল রাজতন্ত্রের একজন উর্ধতন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় আবিদা বেগমের পরিবার এই বিদ্রোহে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করার পাশাপাশি বিপ্লবীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। তার ফলে সিপাহী বিদ্রোহের ব্যার্থ হওয়ার পর মোগল বাদশাহের সাথে সাথে আবিদা বেগমের পরিবার বৃটিশদের অবর্ণনীয় নৃঃশসতার স্বীকার হয়। আবিদা বেগমের সাত বছর বয়সে তার পরিবারের সকলের জনসমক্ষে ফাঁসির ঘটনার দৃশ্য ও তার পরিবারের সদস্যদের ছিন্নভিন্ন করার দৃশ্য নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। সেইদিন থেকে তিনি আমৃত্যু বৃটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শপথ নেন।
পরিনত বয়সে আবিদা বানোর সাথে উত্তরপ্রদেশের সম্ভ্রান্ত মাওলানা ও সমাজসেবী আব্দুল আলী খানের সংগে বিবাহ সম্পন্ন হয়। তার তিন সন্তানই ছিলেন ভারতে চরমপন্থী দের মধ্যে দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ জুলফিকার আলী জওহর, শওকত আলী জওহর, মুহাম্মদ আলী জওহর। মুহাম্মদ আলী জওহর সাহেব জন্মানোর কিছুদিন পর আব্দুল আলী খান সাহেব ইহলোক ত্যাগ করেন। শোকগ্রস্থ অবস্থাতেও আবিদা বেগম তিন সন্তানকেই নিজ দায়িত্বে শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় গড়ে তুলতে থাকেন। তার তিন ছেলেকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা গোঁড়ামীর সত্ত্বেও উর্দু, আরবী, ফার্সি, পাশাপাশি সংস্কৃত, হিন্দী, ও ইংরেজি ভাষা ও উচ্চ শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।
উচ্চশিক্ষিত তিন ছেলের কাছে বৃটিশদের আনুগত্যের স্বাচ্ছন্দ্য, আরামের জীবন উপলব্ধ, অফুরন্ত আর্থিক সংস্থানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উচ্চরাজপদ ত্যাগ করে মায়ের আদেশে তিন ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের নিজেকে অর্পন করেন।
আবিদা বেগম তার তিন ছেলেকে নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করেন। এবং স্বদেশী ও পূর্ণ স্বরাজ তত্ত্বে নিজেদের নিয়োজিত করেন। আবিদা বেগম বলতেন- "যদি আমার সাত সন্তান থাকতো; তবে সবাইকে এই মুলকের জমীনের খেলাফতের জন্য কুরবানী করে দিতাম"! তিনি কংগ্রেসের নারী ফ্রন্টের মধ্যে খাদির ব্যবহার, বিলাতি বর্জন, ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রচার করতে থাকেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাবুলে মাওলানা বরকতুল্লাহ দেওবন্ধী, মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্ধী, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যখন "আর্জি–হুকুমত–মোক্তার–হিন্দের" খসড়া হিসেবে "বার্লিন কমিটি" গঠন হয়। সেসময়ে তারা মারাত্মক আর্থিক সংকটের সন্মুখীন হয়। আবিদা বেগম নিজ সঞ্চয়ের অর্থ তার ছোট ছেলে মুহাম্মদ আলী জওহর কর্তৃক লন্ডন থেকে "বার্লিন কমিটি" হাতে তুলে দেন। এছাড়া গান্ধী বনাম দেশবন্ধু দ্বন্দ্বের সময় তিনি দেশবন্ধুর পক্ষ অবলম্বন করেন ও অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, মুক্তিসংঘ(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স), হিন্দুস্থান সোস্যালিষ্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন, গদর পার্টি সহ স্বরাজ্য পার্টির তহবিলে আবিদা বেগম তার সমস্ত অর্থ উজাড় করে দেন।
১৯১২ সালে বলকান ও ত্রিপোলির যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত হলে বৃটিশরা তুরস্কের ইসলামী অটোমান খলিফাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। তুরস্ক এই যুদ্ধে পরাজিত হলে তারা তুরস্কের খলিফাতন্ত্রের উচ্ছেদ প্রকৃয়া শুরু হলে ভারতে খিলাফত আন্দোলন তীব্র শুরু হয়। আবিদা বেগম তিন ছেলেকে নিয়ে এই আন্দোলনে অগ্রসর হন। ১৯১৪ সালে বৃটেন তুরস্কের ও ভারতের উপর বিশ্বযুদ্ধ চাপিয়ে দিলে মুহাম্মদ আলী জওহর সাহেব লন্ডন অবস্থানকালীন "দ্য চয়েজ অফ তুর্ক" লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ও ভারতে ১৯১১ সালে উর্দুতে জাতীয়তাবাদী পত্রিকা "হামদর্দ " এর তীব্র প্রতিবাদী প্রতিবেদন প্রকাশিত করলে বৃটিশরা ক্ষিপ্ত হয়ে হামদর্দ ও দ্য কমরেড পত্রিকা নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে তিন ভাইকে সাতবছর বিনা বিচারে বন্দী করে রাখে। আবিদা বেগম এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তাদের কার্যক্রম ও ভারতে স্বশস্ত্র বিপ্লবীদের একছাতার তলায় আনার কাজ করতে থাকেন। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে চরমপন্থীদের সংগে গান্ধীবাদীদের সংঘাতে চরমপন্থী গোষ্ঠিকে তিনি গোপনে আর্থিক, বৈপ্লবিক, ও রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে থাকেন। ১৯২৩ সালে তার তিন ছেলে মুক্তি পাওয়ার পর অক্লান্ত পরিশ্রমে আবিদা বেগমের শরীর ভেঁঙে পড়ে। ১৯২৪ সালে ১৪ই নভেম্বর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। অমৃতসরের প্রাচীন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
বৃটিশদের হাতে পরা মাত্র ধরপাকড় শুরু হয়। ১৯১৬ সালে বিশ্বাসঘাতক ওয়াহাবী মতালম্বী হেজাজের বাদশা "আলী বিন হুসাইন" তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে পাঠানো রেশমী রুমালের চিঠি বৃটিশদের গুপ্তচরদের হাতে তুলে দিলে মাহমুদ হাসান হেজাজ থেকে ধরা পড়েন। কাবুলে মাওলানা বরকতুল্লাহ, ওবেইদুল্লাহ সিন্ধী, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সকলে গ্রেফতার হন। তাদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চলে। আলী বিন হুসাইন মাহমুদ হাসানকে বৃটিশদের হাতে তুলে দেয় ও মাল্টার দুর্গে বন্ধী করে।
১৯২০ সালে তিনি মুক্তি পান। ৮ই জুন তিনি ভারতে আসেন। মহাত্মা গান্ধী তাকে স্বাগত জানায় ও খিলাফত আন্দোলনের প্রধান মুখ ঘোষনা করে। খিলাফত কমিটি তাকে "শায়খুল হিন্দ" উপাধি দেয়। তিনি খিলাফত আন্দোলনের সময় বিলাতি বর্জন ও বৃটিশ সংস্কৃতি ত্যাগ করে ভারতীয় চিন্তাধারা গ্রহনের ফতোয়া দেন। ১৯২০ সালে জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের নিয়ে "জামিয়া–মিলিয়া–ইসলামীয়া" বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। ও ভারতীয় চিন্তাধারা ও স্বদেশচেতনার পক্ষে সওয়াল করতে থাকেন। এবং মুসলিম তরুন ছাত্রদের বৃটিশ পক্ষপাতিত্বের ভয়াবহতা ও মুসলিম লীগের বৃটিশদের প্রতি মিত্রতার তীব্র ভৎসনা করে। ১৯২০ সালে দিল্লীতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মঞ্চ হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতিত্বে ভাষণে তিনি উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্যে বলেন– "ভারতে স্বাধীনতার পথ সমাজবাদের পথ; এই স্বাধীনতা তখন প্রাপ্তি হবে যবে মেহনতী শোষিত শ্রেনী অগ্রসর হবে। তাই হিন্দু-মুসলমান-শিখ ঐক্যের আজ ভীষন প্রয়োজন। ভারতে গ্রামগুলিতে এই স্বরাজ সম্ভব। যতদিন না নিস্পেষিত মজদুর উৎপাদক শ্রেনী ঐক্যবদ্ধ হয়; ভারতের স্বাধীনতার পদধ্বনী শ্রবন আমাদের খুব কষ্টসাধ্য হবে না। ১৯২০ সালে জেলের অত্যাচার; রোগভোগ, রক্তাল্পতার ফলে তিনি ইন্তেকাল করেন।