হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, জনাব ইমামুদ্দীনের প্রশ্নটি হল, ‘আমরা প্রায়ই গণ্যমান্য আলেমবৃন্দের মুখে শুনি এবং তাদের লেখায় পড়ে থাকি যে, রাজনীতি ধর্ম থেকে পৃথক নয়। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছেন, ‘খোদার কসম! ইসলামের পুরোটাই হল রাজনীতি।’
আর মরহুম আয়াতুল্লাহ শহীদ মোদাররেস (রহ.) বারংবার বলেছেন, ‘আমাদের রাজনীতি হল হুবহু ধর্মনীতি এবং আমাদের ধর্মনীতি হল হুবহু রাজনীতি।’ এ প্রেক্ষিতে আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজনীতি বলতে কোন্ রাজনীতিকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, আজকের দুনিয়ায় রাজনীতি হচ্ছে নানান মিথ্যাচার, ঠগবাজি, প্রতারণা, শয়তানি খেলা এবং বিভ্রান্তকারী চক্রান্তের ছড়াছড়ি। সুতরাং এমতাবস্থায় ধর্ম কীভাবে হুবহু রাজনীতি হতে পারে?'
উত্তর: রাজনীতি দু’প্রকার। ইতিবাচক ও নেতিবাচক। সুতরাং রাজনীতির খেলা হল নেতিবাচক ও রূপক রাজনীতির অন্তর্গত। সামগ্রিক বিচারে আসলে এটি রাজনীতিই নয়; বরং এক ধরনের ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার নাম, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে ও ধোঁকা দেয় এবং সত্যকে বিকৃত ও উল্টো করে তুলে ধরে; বাতিলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয় করে তোলে; পানিকে মরীচিকা, আর মরীচিকাকে পানি বলে পরিচয় দেয়।
অন্যকথায়, রাজনীতি শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ হল ‘সিয়াসাত’ (سیاست), যা ‘সাস’ (ساس) ও ‘সুস’ (سوس) শব্দমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ হল রাষ্ট্রপরিচালনা, জনগণের বিষয় সমাধা করা, বিভিন্ন দিক থেকে বুদ্ধিমত্তা, সুপরিকল্পনা ও সঠিক কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা, ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচক্ষণতার সাথে উপায় বের করা এবং যে কোন ধরনের দুর্নীতি ও বৈষম্য পরিহার করে চলা। আল্লামা তুরিহী তার ‘মাজমাউল বাহরাইন’ অভিধানে লিখেছেন,
“রাজনীতি হল কোন জিনিসকে যা দ্বারা সমাধান ও সংস্কার করা যায় তা দ্বারা সুরাহা ও সংস্কার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ।”
তিনি আরও লিখেছেন, ‘মাসুম ইমামগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলা হয়েছে- “আপনারা হলেন আল্লাহর বান্দাদের রাজনীতিক।”
রেওয়ায়াতের মধ্যেও রয়েছে যে, দীন ও মিল্লাতের বিষয়াদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নবীর ওপর সোপর্দ করা হয়েছে যাতে উক্ত নবী আল্লাহর বান্দাদেরকে স্বীয় সিয়াসাত তথা রাজনীতির ভিত্তিতে সংশোধন ও প্রতিপালন করেন।
রেওয়ায়াতে আরও এসেছে যে, বনি ইসরাইলের নবিগণ বনি ইসরাইলকে সিয়াসাত তথা রাজনীতি শিক্ষা দিতেন। অর্থাৎ নেতৃবৃন্দ ও শাসকবর্গের মতই তাদের নেতৃত্বের দায়িত্বভার ও ব্যাপার পরিচালনার ভার হাতে তুলে নিতেন এবং তাদের জীবনের বিষয়গুলো পরিকল্পনা, সংস্কার ও পরিচালনা করতেন। আর তাদেরকে এর ভিত্তিতেই প্রতিপালন ও গড়ে তুলতেন। (পাদটীকা- ১)
ভাষাতাত্ত্বিকদের বক্তব্য এবং গবেষক ও পণ্ডিতবৃন্দের বিবৃতি আর রেওয়ায়াতের বর্ণনার প্রতি দৃষ্টি রাখলে প্রতিপন্ন হয় যে, ‘রাজনীতিক’ হল সেই ব্যক্তি যে,
১. ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও জনগণকে পরিচালনা করতে সক্ষম এবং
২. স্বীয় রাজনৈতিক কর্ম-পরিকল্পনায় অতিশয় মেধা, বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ থাকবে। যাতে জেনে-বুঝে দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সমস্যার সঠিক সমাধান করে উন্নতি ও উৎকর্ষের দিকে পরিচালিত করতে পারে। সে যেন অগ্রগতির নিয়ামকসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকে, প্রতিকূলতাসমূহ সম্পর্কে পরিচিত থাকে। আর উন্নতি ও অগ্রগতির সকল নিয়ামকের যথার্থ প্রয়োগ করে এবং যথাসময়ে প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করতে সক্ষম হয়।
এটিই হল সেই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত রাজনীতি। যা নবিগণ ও মাসুম ইমামগণের কর্ম ও আদর্শ ছিল। আর এরূপ রাজনীতিই হুবহু ধর্ম বটে এবং এটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক রাজনীতি। কখনই প্রকৃত ধর্ম যেমন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ইসলাম ধর্ম থেকে এরূপ রাজনীতি পৃথক নয়। এ ধরনের রাজনীতি সম্পর্কেই ইমাম আলী (আঃ) বলেছিলেন, “রাজনীতির সৌন্দর্য হল নেতৃত্বে ন্যায়পরায়ণতা আর ক্ষমতার সময় ক্ষমা।" (পাদটীকা- ২)
ইমাম হাসান (আঃ)'কে জিজ্ঞাসা করা হয়- 'সিয়াসাত কী?' উত্তরে তিনি (আঃ) বলেন, “রাজনীতি হল সেটি যে, তুমি আল্লাহর অধিকার এবং জীবিত ও মৃতদের অধিকার পালন করবে।” (পাদটীকা- ৩)
এ প্রকার রাজনীতির বিপরীতে আরেক প্রকার রাজনীতি রয়েছে। যার অর্থ সাম্রাজ্যবাদ, মিথ্যাচার, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা। যা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোসহ আরও কতিপয় রাষ্ট্রে সাধারণত পরিদৃষ্ট হয়। এসব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোও মূলত এ রূপক ও অন্তঃসারশূন্য রাজনীতির ভিত্তিতেই চলে। আসলে এদেরকে রাজনীতিক বলার চেয়ে রাজনীতিবাজ বলাই শ্রেয়। কারণ, এরা রাজনীতি শব্দটি নিয়ে খেলায় মেতে থাকে। অথচ তাদের নীতি, পন্থা ও কর্ম পরিকল্পনায় সংস্কার ও সংশোধনের জন্য ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতার কোনই লক্ষণ দেখা যায় না। এভাবেই তারা সংশোধন ও সংস্কারের দাবিদার হয় এবং জনগণকে পরিবর্তনের কথা শুনিয়ে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু তাদের কর্মপন্থাই পরিচয় দেয় যে, তারা দুর্নীতির পেছনেই ছুটছে। সংস্কারের মুখোশের আড়ালে তারা আসলে তাদের অশুভ উদ্দেশ্যকেই চরিতার্থ করতে চায়।
আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আঃ) মু‘আবিয়ার রাজনীতিকে এরূপে বিবৃত করেন এবং তার সংস্কারকামিতাকে ঠগবাজি আখ্যা দিয়ে বলেন, “আল্লাহর কসম! মু‘আবিয়া আমার চেয়ে বেশি রাজনীতিবিদ নয়। তবে সে ঠগবাজি করে ও পাপে লিপ্ত হয়। যদি ঠগবাজি মন্দ বৈশিষ্ট্য না হতো তাহলে আমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনীতিক হতাম।” (পাদটীকা- ৪)
আহলে সুন্নাতের বিখ্যাত পণ্ডিত ইবনে আবিল হাদীদ এ উক্তির ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘যদি রাজনীতির অর্থ হয় জনগণের অন্তরগুলোকে যে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, চক্রান্ত, চাটুকারিতা, খোদায়ী সীমারেখা অবজ্ঞা ও অমান্য করা, আর ইসলামী বিধি-বিধানের সীমানা লঙ্ঘন করার কাজে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ করা, তাহলে মু‘আবিয়া হযরত আলী (আঃ)-এর তুলনায় অধিকতর রাজনীতিবিদ। আর রাজনীতি বলতে যদি এর প্রকৃত অর্থ কাজ-কর্ম ও বিষয়গুলোকে ন্যায়-ইনসাফ ও ইসলামী নির্দেশাবলীর ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়, যে রাজনীতি প্রত্যেক মুসলমানের অনুসরণ করা উচিত, তাহলে হযরত আলীই অধিকতর রাজনীতিবিদি।’ (পাদটীকা- ৫)
ফলাফল দাঁড়ায় যে, সত্যিকার রাজনীতি ইসলাম থেকে পৃথক নয়। কিন্তু রাজনীতির খেলা কিম্বা প্রতারণা ও অবৈধ পন্থাসমূহের অর্থে যে রাজনীতি, সেটা ইসলাম থেকে আলাদা বটে। ইসলাম কখনও এরূপ রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রাখে না। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়- রাজনীতি থেকে ইসলামের আলাদা না হওয়ার বিষয়টি চিনতে পারা নির্ভর করে আগে সত্যিকার রাজনীতিকে চেনার ওপর। তদ্রূপ সত্যিকার মুহাম্মাদী (সাঃ) ইসলামকেও চিনতেও হবে। কিন্তু যদি ইসলাম বিকৃত হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রকৃত রাজনীতি থেকে পৃথক। তদ্রূপ নকল রাজনীতিও প্রকৃত ইসলাম থেকে পৃথক। এরই ভিত্তিতে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) জুম‘আর নামাযের আহকামের বিষয়ে লিখেছেন, “সুতরাং যে ব্যক্তি মনে করবে ধর্ম রাজনীতি থেকে আলাদা, সে এমন একজন জাহেল যে না ইসলামকে চিনেছে, আর না রাজনীতিকে চিনেছে।” (পাদটীকা- ৬)
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. আল্লামা তুরিহী, মাজমাউল বাহরাইন, ساس শব্দমূল, নতুন সংস্করণ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৭৮
২. গুরারুল হিকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৪
৩. হায়াতুল হাসান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২
৪. নাহজুল বালাগা,খুতবা নং ২০০
৫. ইবনে আবিল হাদীদ, শারহে নাহজুল বালাগা, ১০ম খণ্ড, পৃ. ২১২
৬. ইমাম খোমেইনী, তাহরীরুল ওয়াসিলা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪
(সূত্র: প্রত্যাশা, বর্ষ- ২, সংখ্যা- ২)