۲۵ اردیبهشت ۱۴۰۳ |۶ ذیقعدهٔ ۱۴۴۵ | May 14, 2024
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা বিকাশের সংকট
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা বিকাশের সংকট

হাওজা / বাঙালি ছাড়া যেমন বাংলা কল্পনা করা যায় না। তেমন বাংলা ছাড়া বাঙালি কল্পনা করা যায় না।

হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘বাঙালি’ এবং ‘বাংলা ভাষা’ এই দুটি শব্দ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাঙালি ছাড়া যেমন বাংলা কল্পনা করা যায় না। তেমন বাংলা ছাড়া বাঙালি কল্পনা করা যায় না। বাংলা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তির কিংবদন্তি থাকলেও বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে। (বাংলা ভাষা)

বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম জনগোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। বিশ্বে বহুল প্রচারিত ভাষাগুলোর মধ্যে সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষার স্থান চতুর্থ থেকে সপ্তমের মধ্যে। ইংরেজি, চৈনিক, স্প্যানিশ ইত্যাদির পরই বাংলা ভাষার স্থান। দক্ষিণ-এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে বাংলা ভাষাটি মূলত ইন্দো-আর্য ভাষা। সংস্কৃত পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের বারাক উপত্যকার রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ।

চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে। বাংলা ভাষার লিপি হলো বাংলালিপি। বাংলা ভাষার ইতিহাস তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. চর্যাপদ (৯০০-১০০০-১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ), দুই. মধ্য বাংলা (১৪০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) এর মধ্যে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ধরা হয় এবং তিন. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)।

চর্যাপদ আবিষ্কার বা রচনাকাল হিসাব করলে এর প্রমাণ মেলে। বাংলা ভাষার গদ্য অবশ্য অনেকটা পরে, লিখিত ভাষার হিসাব অনুযায়ী। প্রত্ন-ভাষার বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এতে এমন কিছু আঞ্চলিক উপাদানের আনুপাতিক আধিক্য আছে, যা পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার অঙ্গ হিসেবে মান্যীকৃত হয়েছে। অর্থাৎ চর্যার প্রত্ন-ভাষায় বঙ্গীয় প্রত্ন-উপাদানের মাত্রা বেশি। উপভাষা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিকার সঙ্গে প্রত্ন-মগধীয় নব্যভারতীয় আর্যভাষার বিকাশের সম্পর্কটি মিলিয়ে দেখলে চর্যাভাষার এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়। চর্যার প্রত্ন-ভাষায় বঙ্গীয় উপাদানের আনুপাতিক আধিক্য থাকায় আলোচ্য মগধীয় প্রত্ন-ভাষাকে প্রত্ন-বঙ্গীয় বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এই অভিধা মেনে নিলে বলতে হয় চর্যাগানগুলোর ভাষা হচ্ছে প্রত্ন-বঙ্গীয় (Proto Bengali) ভাষা।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক পবিত্র, অবিস্মরণীয় দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির চিরপ্রেরণা ও অবিস্মরণীয় একটি দিন। মাতৃভাষার আন্দোলন মূলত বাংলাদেশের হাত ধরেই সারা বিশ্ব ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পেয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, এখন এটি সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে বাংলা ভাষার মর্যাদা দাবি করে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন জব্বার, বরকত, রফিক, সালাম। ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসমের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন শচীন পাল, সুনীল সরকার, কানাইলাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, হিতেন বিশ্বাস, সত্যেন দেব, কুমুদ দাস এবং কমলা ভট্টাচার্য। প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে ২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একুশের লড়াই দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান দিয়েছে। ১৯৫২-র একুশের শহীদরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার পাহারাদার। বাংলাদেশ ভাষার জন্য জীবনদানে পেয়েছে অনন্য স্বীকৃতি। বাঙালির নিজের রক্তে অক্ষর কেনার দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ তার কোনো সীমান্ত নেই। এ এক এমন দিন, যার অস্তিত্ব বিশ্বজুড়ে- সব মানুষের কাছে উজ্জ্বল, ভাস্বর।

পশ্চিমবঙ্গের জন্ম বাংলাদেশের মতো কোনো রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে হয়নি। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, যা বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষাকে চতুর্থ স্থানে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা হলেও হিন্দির আগ্রাসনে সেখানে বাংলা ভাষা প্রতিমুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে! সেই সঙ্গে ইংরেজি তো রয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে অফিস-আদালতে সবখানে হিন্দির দৌরাত্ম্য। অথচ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চর্চার কথা বলা হলেও সেটার কার্যকারিতা ম্লান।

ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতে প্রশাসনিক কাজ মাতৃভাষায় হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা হয় না। হিন্দি আর ইংরেজিতে চলে সব প্রশাসনিক কার্যক্রম। যার ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বাংলা ভাষার। তবে কি বিলুপ্তি হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা ভাষা? এই প্রশ্নটি এখন সব থেকে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়েছে। যে ভাষার জন্য এত আত্মবলিদান, সেই ভাষাকে অবহেলা করে কেন হিন্দি ভাষার চর্চা করা হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি একত্রে করে মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। এটি খুবই বিরক্তিকর! যেকোনো একটি ভাষায় তাদের কথা বলা উচিত। বাংলায় বলতে চাইলে পুরোটা বাংলায় বলতে হবে। হিন্দি বলতে চাইলে পুরোটা হিন্দিতে। ইংরেজির ক্ষেত্রেও তাই। এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা বিপন্নের মুখে পড়বে। অনেক শব্দ হারিয়ে যাবে। ইংরেজি ভাষার ধরনে বাংলা ভাষা বলার প্রবণতা, যাকে বহুবার ‘বাংলিশ’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তাতেও কারও টনক নড়েনি। এই মিশ্র আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের উচিত বাংলা ভাষা ব্যবহারে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করা। মা-মাসিরা যদি বাংলা বলতে পারে, তারা কেন পারবে না? রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ভাষা বাংলা।

এ ছাড়া অনেকে হিন্দি ভাষার বহু ব্যবহারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করছেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইংরেজি শিক্ষার নামে এ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল যাবতীয় পরিষেবা ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে বাংলা ভাষাকেই অবহেলা করছে। এর ফলে মাতৃভাষা চর্চাই শুধু অবহেলিত হচ্ছে না, বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও সংকটে পড়ছে। একটা জাতি তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে বাঙালি তার প্রিয় মাতৃভাষাকে নিজেরাই ক্রমান্বয়ে অস্তিত্বের সংকটের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে রাজ্য সরকারের উদাসীনতা রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। তবে আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে উদাসীন ভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে এবং পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলাপক্ষ’, ‘বাংলা জাতীয় সম্মেলন’, ‘বাংলা ভাষা একতা মঞ্চ’ প্রভৃতি সংগঠন গড়ে উঠেছে।

বাংলায় নাটক, যাত্রা, কবিগান, তরজা, সিনেমা প্রভৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার শ্রোতা খুবই কমেছে। নাট্যমঞ্চ ও সিনেমা হলগুলো কিছুটা বন্ধের মুখে।

কলকাতার বাংলা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ‘নন্দন’-এর সেই নান্দনিকতা আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। এর পাশাপাশি পড়ার সংস্কৃতি, অবক্ষয় এবং ভাষার মানে টান পড়া। একসময় বই পড়াটা ছিল অনেকের কাছেই অভ্যাসের বিষয়। পরিবারগুলোর সংগ্রহে থাকত বই, বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের মধ্যে আদান-প্রদান হতো বই। শিক্ষাক্রম ছিল বইবান্ধব। এখন বই পড়াটা চলে গেছে টিভি দেখা, ইন্টারনেট ঘাঁটা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর চর্চায়।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নিয়ে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘বাংলা ভাষা এই পশ্চিমবঙ্গে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি পাচ্ছে না, বিষয়টি নিয়ে আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আছে।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেক বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যা করে তা কিছুই নয়।’ ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ আর ‘মোদের গরব’ও নয়, ‘মোদের আশা’ও নয়, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। তাই বাংলা ভাষা নিয়ে কোনো বিশেষ আবেগ নেই আমাদের। বরং যা রয়েছে তা হলো কিছুটা অবজ্ঞা মিশ্রিত অবহেলা। তাই বোধহয়, যে ভাষাটির জন্ম ও চর্চা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে, যে ভাষা বাঙালিদের বিপুল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, সেই ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসীরা উদাসীন। বাংলা ভাষা সম্পর্কে এই অবজ্ঞাই ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা সম্পর্কে অনাগ্রহী করেছে। অভিভাবকরাও মনে করেন, বাংলাটা না জানলেও চলবে। এই অনাগ্রহ আর অবহেলার মধ্যেই কিন্তু ভাষার মৃত্যুবীজ লুকিয়ে থাকে।

তবে বাংলা ভাষায় চর্চার ও পীঠস্থান সম্পর্কে আশার কথা শুনিয়েছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘বাংলা ভাষার রাজধানী হবে বাংলাদেশ। জীবদ্দশাতেই তিনি দেখতে পান বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মূলধারা স্থানান্তর হচ্ছে কলকাতা থেকে ঢাকায়। কেবল কলকাতাই নয়, পুরো পশ্চিমবঙ্গে বাংলা এখন অস্তিত্বের সংকটে।’ তাই পরিশেষে আর সি ট্রেন্সের ভাষায় বলা যায়, মাতৃভাষা হচ্ছে মন্দিরের মতো পবিত্র, যার শুচিতা রক্ষার জন্য জীবনপণ করতে দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

تبصرہ ارسال

You are replying to: .