আবুল কাসেম
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, বার ইমামী শিয়ারা হযরত আলী (আ.) এর ইমামতের সপক্ষে অন্যতম যে হাদীসটিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে তা হলো : ‘সত্য আলীর সঙ্গে এবং আলী সত্যের সঙ্গে।’ আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ হাদীসবিদ এবং আলেম এ হাদীসটির সত্যতার বিষয়টি স্বীকার করলেও তাদের কতিপয় আলেম এ হাদীসটির বিষয়ে আপত্তি উঠিয়েছেন। তাদের একজন এ বিষয়ে বলেন : শিয়ারা সর্বসম্মতভাবে বর্ণনা করেছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আলী সত্যের সঙ্গে এবং সত্য আলীর সঙ্গে। সত্য সেদিকে ঘুরে আলী যেদিকে ঘুরে এবং তারা একে অপর থেকে আমার সঙ্গে হাউজে কাওসারে মিলিত হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না।’ কিন্তু বর্ণিত এ হাদীসটি তাদের চরম অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি একটি জাল হাদীস যা রাসূল (সা.) এর ওপর আরোপ করা হয়েছে তাই তা সর্বৈব মিথ্যা। কারণ কোন সহীহ সূত্রে এমনকি জঈফ (দুর্বল) সূত্রেও কেউ রাসূল (সা.) থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। কিভাবে শিয়ারা দাবী করে যে, হাদীসবিদরা সর্বসম্মতভাবে এ হাদীসটি রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন অথচ কোন সাহাবী ও সুন্নী আলেমই এই হাদীসটি বর্ণনা করেন নি এবং তাদের কেউই এরূপ মিথ্যা হাদীস সম্পর্কে অবগত নন। তাই এটি সুস্পষ্ট মিথ্যা যদিও বলা হয়ে থাকে তাদের কেউ কেউ তা বর্ণনা করেছেন এবং তার সত্যতার সম্ভাবনা রয়েছে বলেছেন। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি রাসূল (সা.) এর উপর আরোপিত মিথ্যা।
তার এই বক্তব্যের জবাবে বলব যে তার এই কথা কখনই সঠিক নয়। কারণ এ হাদীসটি আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট আলেমদের অনেকেই কয়েকজন সাহাবা থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। যেমন, খতিব বাগদাদী এবং হাইসামী প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তেমনি হাকিম নিশাবুরী হযরত আলী এবং উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করে তা সহীহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাছাড়া ইবনে কুতাইবা হযরত আয়েশা থেকে এবং ইবনে কাসির আবু সাঈদ খুদরী এবং উম্মে সালামা সূত্রে হাদীসটি বর্ণনার পাশাপাশি তার সমর্থনে অনুরূপ অর্থের কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী হাদীসটির শেষাংশে বর্ণিত : ‘হে আল্লাহ্! সত্যকে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও। আলী যেদিকে ঘুরে’ অংশটি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, কেউ ইসলামের যে কোন বিষয়ে হযরত আলীর অনুসরণ করবে সে সত্য পথ প্রাপ্ত হবে।
এখন আমরা উপরিউক্ত হাদীসবেত্তাদের থেকে বর্ণিত হাদীসগুলিকে বিস্তারিত বর্ণনা করব।
আবু সাঈদ খুদরী থেকে হাইসামী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন : আমরা একদিন কয়েকজন মুহাজির ও আনসারসহ রাসূল (সা.) এর গৃহে অবস্থান করছিলাম। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘আমি কি তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাদের জানাবো?’ আমরা সকলে বললাম: হ্যাঁ, বলুন। তখন তিনি বললেন, ‘যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং আনুগত্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ্ আত্মসংযমী পরহেজগারদের ভালবাসেন।’ তখন আলী ইবনে আবি তালিব আমাদের সামনে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। রাসূল (সা.) তাঁর দিকে ইশারা করে বললেন : ‘সত্য তার সঙ্গে, নিশ্চয় সত্য তার সঙ্গে।’ আবু ইয়ালা এটি বর্ণনা করেছেন এবং বর্ণনাসূত্রে যে সকল রাবী রয়েছেন তারা সকলেই বিশ্বস্ত।
খতিব বাগদাদী আবু জর গিফারীর দাস আবু সাবিত থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন : একদিন আমি মহানবীর স্ত্রী উম্মে সালামার নিকট গিয়ে দেখলাম তিনি হযরত আলীর কথা স্মরণ করে কাঁদছেন এবং বলছেন : আমি মহানবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আলী সত্যের সঙ্গে এবং সত্য আলীর সঙ্গে তারা কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না’।
ইবনে কুতাইবা বর্ণনা করেছেন : যখন জামালের যুদ্ধে আয়েশা যে উটে আরোহণ করেছিলেন তা মারা গেল মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর তার ভগ্নী হযরত আয়েশার নিকট গিয়ে বললেন : ‘তুমি কি রাসূল (সা.)-কে এ কথা বলতে শুননি যে আলী সত্যের সঙ্গে ও সত্য আলীর সঙ্গে। তাহলে কেন উসমানের রক্তের অজুহাতে তার সঙ্গে যুদ্ধের জন্য বের হয়েছো?’
বিশিষ্ট মুফাসসির ফখরুদ্দীন রাজী বলেছেন : যে হযরত আলীকে তার ইমাম ও নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে নিঃসন্দেহে সে নিজের ও তার দীনের জন্য সুদৃঢ় হাতলকে আঁকড়ে ধরেছে। তাই যে ইসলামের বিষয়ে তাঁর অনুসরণ করবে সে অবশ্যই সত্যপথ প্রাপ্ত হবে। তার সপক্ষে দলিল হলো রাসূলের এই হাদীস : ‘হে আল্লাহ্! আলী যেদিকে ঘুরে সত্যকে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও’।
হাকিম নিশাবুরী আলী (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূল বলেছেন : ‘আল্লাহ্ আলীর উপর তাঁর রহমত বর্ষণ করুন। হে আল্লাহ্! আলী যে দিকে ঘুরে সত্যকে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও।’
হাইসামী সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি : ‘আলী সত্যের সঙ্গে এবং সত্য আলীর সঙ্গে সে যেখানেই থাকুক না কেন।’ সা'দের একথা শুনে (মদীনার বাইরে থেকে আগত) এক ব্যক্তি তাকে প্রশ্ন করল (তুমি ছাড়া) কে এ কথা শুনেছে? সা’দ বললেন, এ কথা রাসূল (সা.) উম্মে সালামার গৃহে বলেছেন। এরপর তাকে উম্মে সালামার নিকট প্রেরণ করলেন। ঐ ব্যক্তি উম্মে সালামাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, হ্যাঁ, মহানবী (সা.) আমার গৃহে এ কথা বলেছেন। তখন ঐ ব্যক্তি সা’দকে উদ্দেশ্য করে বলল : তুমি যেহেতু এ হাদীসটি জান সেহেতু আমার দৃষ্টিতে তুমি তিরস্কারের যোগ্য। তিন বললেন : কেন? সে বলল : যদি আমি রাসূলের নিকট এ হাদীস শুনতাম (এবং আলীকে জীবিত পেতাম) তবে আমার মৃত্যু পর্যন্ত আলীর সেবক হিসেবে থাকতাম।
হাইসামী এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে সাঈদ ইবনে শুয়াইব ব্যতীত অন্য সকলকে বিশ্বস্ত বলেছেন। কিন্তু শামসুদ্দীন ইবরাহীম জাউযাজানী তাকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বলেছেন।
হযরত আবুজর গিফারী মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন : ‘হে আলী! যে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হলো সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর থেকে বিচ্ছিন্ন হলো এবং যে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সে নিশ্চিতভাবে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।’
উপরিউক্ত হাদীসগুলি বর্ণনার পর আলোচ্য হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দেহ উদ্রেককারী ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই এ হাদীসগুলির প্রতিটি, বিশিষ্ট সাহাবীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যাদের মধ্যে হযরত আলী, উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা ও আয়েশা, সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস এবং অন্যান্যরা রয়েছেন। কিভাবে তিনি দাবী করেন যে সাহাবাদের কেউই রাসূল (সা.) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন নি? তাহলে কি তিনি এসকল ব্যক্তিকে সাহাবা মনে করেন না? হাইসামী, ফখরুদ্দীন রাজী, হাকিম নিশাবুরী কি আলেমদের মধ্যে গণ্য নন? তবে তিনি কেন এমন দাবী করেছেন যে, কোন আলেমই তা বর্ণনা করেন নি। আমি ঐ ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে চাই এ হাদীসটির মধ্যে সত্য হওয়ার অন্তরায় কোন নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে কি? এর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অসম্ভব বলে গণ্য কিছু বলা হয়েছে কি? না কি সে এ বিষয়কে অসম্ভব মনে করে যে, সত্য আলী (আ.)-কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। সে কি ভুলে গিয়েছে মহান আল্লাহ্ আলীকে পবিত্র কোরআনে পবিত্র ঘোষিতদের অর্ন্তভুক্ত করেছেন? যদি তার মত এমন হয় যে, কোন হাদীস সিহাহ সিত্তায় বর্ণিত না হলে তা গ্রহণ যোগ্য নয়- তবে তাকে বলব তিরমিযী তার সহীহ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আর তার কাছে যদি সহীহ বুখারী ও মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন হাদীস গ্রন্থের হাদীস গ্রন্থকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের আকীদা ও বিধি-বিধান (আহকাম) সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস পরিত্যাজ্য বলে গণ্য হবে এবং তখন তাদের বিশ্বাস ও আমলের ভিত্তিই ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ নিঃসন্দেহে আহলে সুন্নাতের সর্বসম্মত মত হলো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ব্যতীত সিহাহ সিত্তার অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ ও নির্ভরযোগ্য এবং আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন সুনান ও মুসনাদ গ্রন্থসমূহের মধ্যে বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে যা নির্দ্বিধায় সহীহ বলে গণ্য। তাই তারা তার উপর ভিত্তি করে অনেক কিছুই বিশ্বাস করেন এবং অনেক বিষয়েই ফতওয়া দান করে থাকেন যদিও বুখারী ও মুসলিম তা উল্লেখ করেন নি। উদাহরণ স্বরূপ মালিক ইবনে আনাসের মুয়াত্তা, আহমাদ ইবনে হাম্বালের মুসনাদসহ অনেক হাদীস গ্রন্থ দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে এবং তাতে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে সহীহ বলে গণ্য প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
‘সত্য আলীর সঙ্গে’ হাদীসের অর্থ বিশ্লেষণ :
পবিত্র কোরআন দুই স্থানে মহান আল্লাহ্ নিজেকে ‘হাক্ব’ বা সত্য বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা লোকমানে মহান আল্লাহ্ বলেন :
‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ্ তিনিই সত্য।’
সূরা নূরে বলেছেন :
‘নিশ্চয় আল্লাহ্ তিনিই সুস্পষ্ট সত্য।’
আবার কোরআনে কোন কোন স্থানে আল্লাহ্ ‘সত্য তাঁর থেকে’ বলেছেন। যেমন, ‘সত্য তোমার প্রতিপালকের থেকে।’ কিন্তু কোরআনে কোথায়ও সত্য আল্লাহর সঙ্গে রয়েছে বলা হয় নি। কারণ তা শিরকের শামিল এজন্য যে, সত্যকে এক্ষেত্রে আল্লাহর পাশাপাশি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে ধারণা করা হয় অথচ মহান আল্লাহ্ নিরঙ্কুশ সত্য।
সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ‘সত্য তার থেকে’ এবং ‘সত্য তার সঙ্গে’ এ দুটি বাক্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যে সকল ব্যক্তি সত্তাগতভাবে সত্যকেন্দ্রিক অথবা সার্বক্ষণিকভাবে সত্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাদের ক্ষেত্রে বলা যায় ‘সত্য তার সঙ্গে।’ যারা সত্তাগতভাবে সত্যকেন্দ্রিক তাদের ক্ষেত্রে সত্য শুধু তাদের সঙ্গে নয় বরং সত্য তাদেরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যেমন, আলোচ্য হাদীস ‘সত্য আলীর সঙ্গে’। আর যে সকল ব্যক্তি সত্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় যদিও সত্তাগতভাবে তারা সত্যের মানদণ্ড নয় তাদের ক্ষেত্রে যদি বলা হয় ‘সত্য তার সঙ্গে’ তবে তার অর্থ হবে এই যে, তারা সার্বক্ষণিকভাবে সত্যের সঙ্গে থাকবে। যেমন আম্মার ইবনে ইয়াসিরের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এরূপ কথা বলেছেন।
কিন্তু কখনই এ কথা বলা যাবে না, ‘সত্য আলী থেকে’ কারণ এ কথা শুধুমাত্র মহান আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য যিনি স্বয়ং সত্য হিসেবে নিরঙ্কুশ। অবশ্য আল্লাহ্ স্বয়ং সত্য এবং সত্য আল্লাহ্ থেকে এ দুয়ের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। যেখানে বলা হয় ‘সত্য আল্লাহ্ থেকে’ সেখানে তার বিপরীতে বাতিল থাকতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে যে সকল অস্তিত্বকে আল্লাহ্ সীমিত স্বাধীনতা দিয়েছেন তারা তাঁর বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ লাভ করেছে। এর বিপরীতে যেখানে আল্লাহ্ নিজেকে সত্য বলেছেন এবং আল্লাহর অন্যতম নাম হিসেবে ‘হাক্ব’ ব্যবহৃত হয় সেখানে তাঁর বিপরীতে কোন কিছুই নেই এবং তিনি অসীম সত্তা হিসেবে তাঁর সমগ্র সত্তাই সত্য। এ অর্থে আল্লাহর বিপরীতে যা রয়েছে তা হলো সম্ভাব্য অস্তিত্ব যারা কেবল আল্লাহর অনুগ্রহেই অস্তিত্ব লাভ করতে পারে। সুতরাং সত্য এক অর্থে আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পর্কিত অন্য অর্থে তাঁর কর্মের সাথে সম্পর্কিত।
‘আলী সত্যের সাথে এবং সত্য আলীর সাথে’ হাদীসে যে সত্যের প্রতি ইশারা করা হয়েছে তা হলো আল্লাহর কর্মের সাথে সম্পর্কিত। তাই তার বিপরীতে যা থাকবে তা বাতিল ও আল্লাহর ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত।
মানুষ যদি সত্যপন্থী হতে চায় তবে তাকে সত্যকে এমন সত্তা বা ব্যক্তি হতে গ্রহণ করতে হবে যার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভুল-ভ্রান্তি ও অসত্যের মিশ্রণ থাকবে না অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে হবে। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
‘যিনি সত্যের দিকে পথ নির্দেশ করেন তিনিই কি অধিকতর অনুসরণযোগ্য, না ঐ ব্যক্তি যাকে পথ না দেখালে সে পথ পায় না।’
এ আয়াতের শেষাংশ থেকে বোঝা যায় যে, আয়াতে উল্লিখিত উভয় হেদায়াতকারী সত্যের দিকে পথ নির্দেশনা দেয়, তবে তাদের একপক্ষ নিরঙ্কুশ সত্য হিসেবে স্বয়ম্ভর ও অমুখাপেক্ষী কিন্তু অপর পক্ষ মুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীল। সুতরাং উপরের আয়াতে লিখিত সত্যের নিদর্শন হলেন শুধুমাত্র মহান আল্লাহ্। তবে এই নিরঙ্কুশ সত্যের রঙে রঞ্জিত একদল ব্যক্তি রয়েছেন যারা তাঁর গুণাবলীর প্রকাশস্থল। যেহেতু আল্লাহর গুণাবলীর প্রকাশ তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে ঘটেছে তারাও সত্যের রূপ লাভ করেছেন এবং তাদের মধ্যে অসত্য ও ভ্রান্তির কোন লেশ নেই। ‘সত্য আলীর সঙ্গে এবং আলী সত্যের সঙ্গে’ হাদীসটি এ বিষয়ের প্রতিই ইশারা করেছে।
যেমনভাবে কোন ব্যক্তি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর এতটা নিকটবর্তী হয় যে, আল্লাহ্ তার হাত, চোখ, কর্ণে পরিণত হয়। ফলে সে আল্লাহর চাওয়ার বাইরে কোন কর্ম সম্পাদন করে না। তেমনিভাবে বিশেষ ব্যক্তিবর্গ ফরয ইবাদতের মাধ্যমে এমন স্থানে পৌঁছেন যে, তাঁরা আল্লাহর হস্ত, চক্ষু ও কর্ণে পরিণত হন। তখন তাদের মধ্যে আল্লাহর ভালবাসা ছাড়া কিছুই থাকে না। ফলে তারা যা চান ও বলেন আল্লাহ্ তাই চান ও করেন। হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে রাসূলের প্রসিদ্ধ হাদীস ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ ফাতেমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন’ এ ব্যাখ্যার সত্যতাকে প্রমাণ করে। ‘সত্য আলীর সঙ্গে এবং আলী সত্যের সঙ্গে’ হাদীসটিও এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে যে, আলী (আ.) আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভের কারণে তাঁর থেকে সত্যকে এমনভাবে লাভ করেছেন ও আত্মস্থ করেছেন যে তার থেকে সত্য কথা ও কর্ম ব্যতীত অন্য কিছুই উৎসারিত হয় না। তাই সত্য আলীর অনুবর্তী অর্থাৎ আলী যে দিকে ঘুরে সত্য আলীকে কেন্দ্র করে সেদিকেই আবর্তিত হয়।
শিয়ারা বিশ্বাস করে শুধুমাত্র হযরত আলী নন বরং মহানবী (সা.) এর থেকে বর্ণিত হাদীসে সাকালাইনের ভিত্তিতে বলা যায় তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকে মনোনীত ইমামগণও অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারণ এ হাদীসে বলা হয়েছে তারা হাউজে কাউসারে রাসূল (সা.) এর সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পবিত্র কোরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। এ বাক্যটি তাদের চিরন্তন সত্যপন্থী হওয়ার দলিল।
ইমামদের থেকে বর্ণিত বিভিন্ন বর্ণনায় তাঁদেরকে জিয়ারতের জন্য যে বাক্যাবলী শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাতে কখনও বলা হয়েছে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলতে হবে ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে রয়েছি আপনাদের ভিন্ন অন্য কারো সঙ্গে নয়।’ এসকল জিয়ারতে সকল অবস্থায় তাদের সঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞা করতে বলা হয়েছে। ইমাম হোসাইনের প্রসিদ্ধ জিয়ারত ‘জিয়ারতে আশুরাতে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করে বলা হয় ‘আপনাদের সঙ্গে যারা সন্ধি করেছে আমরাও তাদের সঙ্গে সন্ধি করি এবং যারা আপনাদের সাথে যুদ্ধ করে আমরাও তাদের সাথে যুদ্ধ করি।’
পরিশেষে বলা যায় মহানবীর আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ এবং তাদের শীর্ষে আলী (আ.) সত্যের চিরন্তন মানদণ্ড। তাই সত্য তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই এবং তার শত্রুরা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত। এজন্যই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আলী শ্রেষ্ঠ মানব। যে কেউ তাকে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করবে নিশ্চয় সে অবিশ্বাসী।