হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, মিশরের রাজধানী কায়রোতে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বিশ্ব নবী সাঈয়েদীনা মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবারের বেশ কজন সদস্যসহ নাম না জানা অসংখ্য সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি, ঈমাম, সুলতান, রাজা বাদশাহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মহানবী'র (সা.) নাতী ও জান্নাতিদের নেতা সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)।
ইসলামি বর্ষপঞ্জি হিজরি সালের প্রথম মাস মহররম, আশুরা খ্যাত ৬১ হিজরীর ১০ মহররম শুক্রবার অপরাহ্নে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার বাহিনীর হাতে ইমাম পরিবারে পুরুষ বলতে সবারই শাহাদাত ঘটে।
শাহাদতের পর ইবনে জিয়াদের নিষ্ঠুর সেনা নরপিশাচ সীমার ইবনে জিলজুশান মুরাদী নিজ হাতে ছুরি চালিয়ে মহানবী সাইয়েদীনা মোহাম্মদের (সা.) দৌহিত্র ইমাম হোসাইন ইবনে আলীর (আ.) পবিত্র দেহ থেকে মাথা মোবারককে আলাদা করে এবং সেই পবিত্র মাথা মোবারকসহ ৭২ শহীদের মাথা ও ইমাম পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে হাজির হয় শামে ইবনে জিয়াদের কাছে।
নবী পরিবারের সূত্রে ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া আহলে বায়াতের নারী ও শিশুদের বন্দি করে রেখে চরম অপমান ও নির্যাতন করেন। ইমাম হোসাইনের (আ.) ছয় বছরের ছোট্ট কন্যা বাবার জন্য কান্না করলে তাকে চড় মেরে রক্তাক্ত করা হয় এবং তার কান্না থামানোর জন্য তার সামনে ইমাম হোসাইনের (আ.) দ্বিখণ্ডিত ও রক্তাক্ত মাথা ছুঁড়ে মারা হয়। ইমাম হোসাইনের ছোট্ট কন্যা সেই মাথা মোবারক দেখে আত্মচিৎকারে বন্দি অবস্থায় সেখানে মারা যায়। পরে পরিস্থিতি বিবেচনায় ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া নবী পরিবারের নারী ও শিশুদের মদীনা মুনাওয়ারায় পাঠিয়ে দেন এবং মানুষের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে হোসাইন (আ.)'র শির (মাথা) মোবারক দামেস্কের দরজায় ঝুলিয়ে রাখেন। তারপর শির মোবারক দামেস্কের সালাম নামক এক মালখানায় কিছুদিন রাখার পর ঈমাম হোসাইনের (আ.) শির মোবারক দামেস্ক থেকে কুফা ও বিভিন্ন জায়গায় চরম অপমানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ প্রদক্ষিণের পর ভূমধ্যসাগরের তীরে (বর্তমান ফিলিস্তিনের মিনা) আস্কালান নামক স্থান দাফন করা হয়।
হোসেইনের (রা.) শির মোবারক নিয়ে আরও প্রচলিত আছে যে, তার পবিত্র শির ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া মাটি চাপা দেয়ার নির্দেশ দেয়। তার রাজ দরবারে আস্কালান (দক্ষিণ ফিলিস্তিনের অঞ্চল) একদল লোক ইমাম হোসাইনের (আ.) মাথা মোবারক দাফন করার আগ্রহ ব্যক্ত করলে পরে তাদের তা দিয়ে দেওয়া হয়। তারা তা ফিলিস্তিনের আসকালানে (বর্তমান ইসরায়েল) দাফন করেন।
৫৪৯ হিজরিতে আসকালান ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা যখন ক্রুসেডারদের দ্বারা শাসিত হচ্ছিল এবং তারা মুসলমান মনিষীদের কবরগুলো ধ্বংসের পাঁয়তারা করছিল, তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে অচিরেই ক্রুসেডাররা আসকালান নগরীতে অবস্থিত হজরত হোসেইনের (আ.) শির উত্তোলন করবে।
তখন মিশরের শিয়া মতাদর্শী ফাতেমি খলিফা তার উজিরের পরামর্শে ইমাম হোসাইন (আ.)’র শির মোবারক কায়রোতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন এবং এক বিশাল অর্থের বিনিময়ে তৎকালীন মিশরের ফাতেমীয় আমীর কায়েদুল জুয়ুস বদরুদ্দিন ৮ জমাদিউল আখর (রোববার) আসকালান হতে শিরমোবারক সংগ্রহ করে ১০ জুমাদিল আখার (মঙ্গলবার) সুরক্ষিত মিশরে যথাযথ মর্যাদার সাথে নিয়ে আসেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মাকিরজি বলেন, ইমাম হোসাইন (আ.) শির মোবারক ফিলিস্তিনের আস্কালান থেকে ৮ জমাদিউল আখের ৫৪৮ হিজরিতে উত্তোলন করে সোনারুপা খচিত সবুজ রঙের একটি সিন্দুকে করে মিশরের কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয় (কায়রোর ইসলামিক জাদুঘরে সেই সিন্দুকটি এখনো সংরক্ষিত আছে)।
দুইদিন পর ইমাম হোসাইন (আ.)'র মাথা মোবারক মিশরে পৌঁছানোর পর তৎকালীন রাজা আমীর সাইফ সেই মাথা মোবারক গ্রহণ করেন। তখন ইমাম হোসাইন (আ.)'র মাথা মোবারককে দেখার জন্য মিশরের লাখ লাখ মানুষ কায়রোতে ছুটে আসেন, শোক প্রকাশ করেন এবং ইমামের শির মোবারককে সম্মান জানাতে খালি পায়ে পুষ্প হাতে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
৫৪৮ হিজরী ১০ জমাদিউল আখর ইসলামিক কায়রোতে হযরত ইমাম হোসাইনের (আ.) মস্তক মোবারক পুনঃসমাহিত করা হয় ও একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যা আজকের সাইয়েদীনা ইমাম হোসাইন মসজিদ বা গামা-ঈল- হোসাইন নামে পরিচিত।
মিশরের শাসক ইসমাইল খুদাইভির সময়ে তৎকালীন মিশরে ইমাম হুসাইন (আ.)'র শির মোবারকের সত্যতা নিয়ে মানব মনে ফেতনা দেখা দেয়। আসলেই কি শির মোবারক এখানে আছে কি নেই? এ নিয়ে ঐতিহাসিক আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সময়ে নির্ভরযোগ্য বিশিষ্ট তিন আলেম নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হয় এবং শির মোবারক পর্যবেক্ষণ করতে সেই তিন আলেম মাকাবার ভেতরে প্রবেশ করেন ও সাক্ষ্য দেন যে এটিই ইমাম হোসাইন (আ.)'র শির মোবারক।
তিন সদস্যের পর্যবেক্ষণ কমিটি শির মোবারক থেকে তাজা রক্ত ঝরতে দেখে বলেন যে, মনে হয় কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে শহীদ করা হয়েছে, আর তা হতে মেশকের সুভাস অনুভূত হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: সূত্র:
১। তাসাউফের শায়খ জাকিউদ্দিন ইবরাহীম রচিত "ﺭﺃﺱ ﺍﻹﻣﺎﻡ ﺍﻟﺤﺴﻴﻦ ﺑﻤﺸﻬﺪﻩ ﺑﺎ ﺍﻟﻘﺎ ﻫﺮﻩ ﺗﺤﻘﻴﻘﺎ ﻣﺆﻗﺪﺍ ﺣﺎﺳﻤﺎ’’ নামক কিতাব ও
২। মিশরের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী ড. আলী জুমা লিখিত ‘‘ﺍﻟﺒﻴﺎﻥ ﺍﻟﻘﺆﻳﻢ’’ নামক কিতাব।