রিপোর্ট: হাসান রেজা
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, যে ভূমির বাসিন্দারা কয়েক দশক ধরে সন্ত্রাসের চুল্লিতে পুড়ছে, আবারও তারা রক্তক্ষয়ী হামলার কবলে পড়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অতৎপরতায় পেশোয়ারগামী কনভয়ের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলায় নিরীহ মানুষদের শাহাদাতের ঘটনায় হৃদয় ছিঁড়ে যায়। এ হামলা শুধু মানবতার ওপর হামলা নয়, রাষ্ট্র ও তার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মক্ষমতাকেও মারাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
প্রতিনিয়ত পারাচিনারকে উপেক্ষা করা, সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং প্রতিটি ট্র্যাজেডির পর স্বাভাবিক নিন্দা বিবৃতি দেওয়া মাজলুম গাজাবাসীর কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে নিরীহ মানুষ অনবরত অত্যাচারের শিকার হচ্ছে।
এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় যে, পারাচিনারের মতো একটি স্পর্শকাতর এলাকায় যেখানে সন্ত্রাসের প্রতিনিয়ত হুমকি রয়েছে, সেখানে নিরাপত্তা সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকা একটি কনভয় সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হল, এত বিপুল সংখ্যক খুনি কোথা থেকে এল? তারা কোথায় লুকিয়ে ছিল? তারা কোথা থেকে অস্ত্র ও সম্পদ পাচ্ছে? নিরাপত্তা সংস্থার কাজ জনগণকে রক্ষা করা; কিন্তু স্বয়ং তাদের সঙ্গী কাফেলাও এখানে নিরাপদ নয়।
কয়েক দশক ধরে নিপীড়নের কলে পিষে থাকা পারাচিনার আজ একটি "পাকিস্তানি গাজার" দৃশ্য উপস্থাপন করছে। এখানকার জনগণ প্রতিদিন সন্ত্রাসী হামলা, তাকফিরি-খারেজী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বর্বরতা এবং সরকারের উদাসীনতার সম্মুখীন হচ্ছে।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি দিনের আলোতে কাজ করে এবং তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়, যেন তাদের সহায়তা করার পিছনে কোনও হাত রয়েছে।
পারাচিনার মানুষের প্রশ্ন তাদের জমি কি শুধুই কোরবানির ক্ষেত্র, এখানকার মানুষের রক্ত কি এত সস্তা?
দুর্ভাগ্যবশত, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং ফেডারেল সরকার উভয়ই বর্তমানে রাজনীতির খেলায় এতটাই ব্যস্ত যে তারা পারাচিনার বা প্রদেশের অন্যান্য সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে মনোযোগ দিতে পারছে না। কেবল প্রতিশ্রুতি এবং বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু বাস্তব ও কার্যকরী ব্যবস্থা অনুপস্থিত।
প্রতিটি রক্তক্ষয়ী ট্র্যাজেডির পর নিন্দা জানিয়ে প্রচলিত বিবৃতি দেওয়াই যথেষ্ট নয়। এখানকার মানুষ রাষ্ট্রের কাছে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি জানাচ্ছে।
আর দেরি না করে রাষ্ট্রকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পারাচিনারের মতো এলাকার মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। সন্ত্রাসীদের সহায়তাকারীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনা এবং নির্যাতিতদের বিচার করা এখন সময়ের দাবি।
পারাচিনারের মানুষ আর লাশ বহন করতে পারছে না। নিজ ভূমিতে শান্তিতে বসবাস করা মানুষের অধিকার। সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে, অন্যথায় ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
পারাচিনারকে পাকিস্তানি গাজা হতে দেবেন না। বাস্তব ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে, অন্যথায় এই নিপীড়িত অঞ্চলটির মানুষও আশা হারাবে।
এই মর্মান্তিক ঘটনা নিছক আক্রমণ নয়, বরং এটি মানবতার মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ। এটি এমন নৃশংসতা যা প্রতিটি সংবেদনশীল হৃদয়কে কাঁপিয়ে দেয়। নিষ্পাপ শিশুর নিষ্পাপ চোখে ভয়ের ছায়া, নারীর আর্তচিৎকারে অসহায়ত্ব আর যুবকদের প্রাণহীন লাশ এই নিষ্ঠুরতার গল্প বলে। এটা শুধু মৃতদেহ নয়, পুরো জাতির আস্থা, শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্নের হত্যা।
মনে হচ্ছে পারাচিনারকে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হচ্ছে যেখানে শান্তির কোনো ধারণাই অবশিষ্ট নেই। এ অঞ্চলের মানুষ শুধু বাড়িঘর, জমিজমা ও সন্তান-সন্ততি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না, তাদের আশা-স্বপ্নও রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই সময় শুধু আফসোস নয়, জেগে ওঠার, এটাই সময় ন্যায় প্রতিষ্ঠার। রাষ্ট্রকে শুধু এই নিপীড়িত অঞ্চলের ক্ষত সারাতে হবে না, তাদের খুনিদেরকেও শিক্ষা দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এভাবে মানুষের জীবন ধ্বংস করার সাহস না পায়।
পারাচিনারের বাসিন্দাদের শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার তাদের যে কোনো মূল্যে দিতে হবে। এই রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি শুধু পারাচিনারের জনগণের জন্যই নয়, সমগ্র পাকিস্তানি জাতির জন্য লজ্জাজনক।
নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণহীন লাশ, মায়েদের অসহায়ত্ব এবং বৃদ্ধদের কান্না এমন এক ট্র্যাজেডির ছবি এঁকেছে যা আমাদের সম্মিলিত বিবেককে নাড়া দিতে যথেষ্ট।
এই এলাকা, যেখানে একসময় শিশুদের হাসির প্রতিধ্বনি ছিল, এখন কি চিরদিনের জন্য শোকের জায়গা হয়ে উঠবে? প্রত্যেক শহীদের রক্ত প্রশ্ন করে তাদের কি দোষ ছিল? তাদের অপরাধ কি শুধু এটাই ছিল যে তারা শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে থাকতে চেয়েছিল?
পারাচিনারের মানুষের এসব পরীক্ষা তাদের ধৈর্য, অধ্যবসায় ও দেশ প্রেমের পরীক্ষা নিচ্ছে। এখানে প্রতিদিন রক্তের হোলি খেলা হয়; কিন্তু তাদের কষ্ট আর কান্না শোনার কেউ নেই। এই ভুক্তভোগীদের ভগ্ন ও আহত হৃদয় শুধু বিচার চাইছে।
সন্তানদের নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা এখানকার মায়েরা এখন তাদের সন্তানদের কবরস্থানের মাটিতে দাফন করছেন। প্রগতির স্বপ্ন দেখা এই যুবকরা এখন হাতে-নাতে জানাজা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
পারাচিনার শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের সম্মিলিত বিবেককে নাড়া দেয়। এটি দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার এবং ক্ষত নিরাময়ের সময়, প্রতিশ্রুতি এবং বাগ্মিতা নয়। এগুলি নিরীহ মানবতার আর্তনাদ, ন্যায়, নিরাপত্তা, শান্তি ও ন্যায়বিচারের জন্য আর্তনাদ। আজও যদি এই কণ্ঠস্বর শোনা না যায়, তাহলে এই নীরবতা আমাদের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা আমাদের সর্বদা তিরস্কার করবে।