হাওজা নিউজ এজেন্সি বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ওয়ালহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিউ ওআলিহিত তাহিরিন ওসাহবিহিল মুনতাজিবিন, ওয়া মান তাবিয়াহুম বিইহসানিন ইলা ইয়াওমিদ্দিন।
সারা বিশ্বের মুসলিম ভাই ও বোনেরা!
এ বছরও মুসলিম উম্মাহ হজ্বের মহান নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আগ্রহীরা দীর্ঘশ্বাস ও অনুশোচনার মাধ্যমে প্রজ্ঞাময় ও দয়ালু আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত সম্মানিত ঘরে আতিথেয়তার সুযোগ হাতছাড়া করেছে। পরপর দুই বছর ধরে হজের উৎসব ও আধ্যাত্মিক আনন্দ পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্নতা ও অনুশোচনায়। মহামারির বিপর্যয় এবং হয়তো হারাম শরিফ সংক্রান্ত নীতিমালার বিপর্যয়, মুমিনদের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, মাহাত্ম্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রদর্শনী অবলোকনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে এবং গৌরবময় এই উজ্জ্বল চূড়া ঢাকা পড়ছে। ইতিহাসের অন্যান্য পরীক্ষার মতো এই পরীক্ষাটিও মুসলিম উম্মাহকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো হজকে এর প্রকৃত রূপে মুসলমানদের হৃদয় ও মনে অটুট রাখা। বর্তমানে হজের আনুষ্ঠানিক কাঠামোটি সাময়িকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও এর বার্তার গুরুত্ব যেন হ্রাস না পায়।
হজ হচ্ছে রহস্যে ভরা এক ইবাদত। এর গতি ও স্থিরতার চমৎকার গাঁথুনি ও মিশ্রণ মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পরিচিতি গঠন করে এবং গোটা বিশ্বের সামনে মুসলিম উম্মাহর সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। এছাড়া আল্লাহর স্মরণ,তার প্রতি অনুনয়-বিনয় ও তার প্রার্থনার মাধ্যমে মানব হৃদয় আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহযোগিতা করে। অন্যদিকে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সমবেত সবার একই ধরণের পোশাক,আচার-অনুষ্ঠান ও সমন্বিত পদক্ষেপ পারস্পরিক বন্ধন তৈরি করে। হজে অর্থবহ ও রহস্যময় রীতি-নীতির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সর্বোত্তম রূপ গোটা বিশ্বের সামনে প্রদর্শিত হয় এবং অকল্যাণকামীদের সামনে মুসলমানদের দৃঢ়তা ও মাহাত্ম্য তুলে ধরা হয়।
এ বছর আল্লাহর ঘরে গিয়ে হজের সুযোগ নেই। কিন্তু আল্লাহর ইবাদত, তার স্মরণ,তার কাছে নিজেকে সমর্পণ,তার কাছে অনুনয়-বিনয় করা এবং ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ রয়েছে। আরাফাতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আরাফাতের দিন আধ্যাত্মিকতাময় দোয়া ও মুনাজাতের সুযোগ রয়েছে। মিনায় উপস্থিত হয়ে শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ সম্ভব নয়,কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু শয়তানদেরকে প্রত্যাখ্যানের সুযোগ সর্বত্রই বিদ্যমান। কাবার পাশে শারীরিক উপস্থিতির সুযোগ নেই,কিন্তু আল্লাহর পবিত্র কুরআনের ছায়াতলে সবার হৃদয়-মনের উপস্থিতি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরা সবার সব সময়ের দায়িত্ব।
আমরা মুসলমানেরা এখন সংখ্যায় অনেক। আমাদের রয়েছে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। মুসলিম জাতি সজাগ ও সচেতন রয়েছে। কাজেই আমাদের বিপুল সম্পদ,সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ গঠনে তৎপর হতে হবে। গত দেড়শ’ বছরে মুসলিম জাতিগুলো তাদের দেশের ভবিষ্যৎ ও সরকার গঠনে কোনও ভূমিকাই পালন করতে পারেনি এবং কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পাশ্চাত্যের আগ্রাসী সরকারগুলোর নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমেই মুসলমানেরা পরিচালিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের লোভ-লালসা ও হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। বর্তমানে অনেক দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে রয়েছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও পরনির্ভরশীল। নিজেদের সক্রিয় ভূমিকার অভাব এবং দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়েছে। এখন মুসলিম বিশ্বের যুবসমাজ,বিজ্ঞানী, আলেম,বুদ্ধিজীবী,রাজনীতিবিদ এবং দল ও সংগঠনসহ সবাইকে অবশ্যই সেই অপমানকর ও লজ্জাজনক অতীতের ভুলগুলো শুধরাতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে এবং পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর জোর-জবরদস্তি, হস্তক্ষেপ ও অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তুলতে হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণ ঐ একটাই। আর তাহলো প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইরানের আহ্বান; অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য আগ্রাসী শক্তির হস্তক্ষেপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ইসলামী শিক্ষার আলোকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ।
স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘প্রতিরোধ’ কথাটির ব্যাপারে স্পর্শকাতর এবং তারা ‘ইসলামী প্রতিরোধ ফ্রন্ট’-এর বিরুদ্ধে নানা ধরণের শত্রুতা করে যাচ্ছে। আর এই অন্যায় ও অপকর্ম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক কিছু সরকারের সহযোগিতা এক তিক্ত বাস্তবতা।
তাওয়াফ,সাঈ,আরাফাতে উপস্থিতি,শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপসহ হজের নানা আনুষ্ঠানিকতা,রীতি-নীতি,মহিমা এবং ঐক্য ও সংহতি আমাদেরকে যে সোজা ও সরল পথটি দেখায় তাহলো আল্লাহর ওপর নির্ভরতা,চিরন্তন ঐশী শক্তি উপলব্ধি,জাতীয় আত্মবিশ্বাস,চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের প্রতি আস্থা,দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা এবং বিজয়ের ব্যাপারে অফুরন্ত আশাবাদ।
মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা এই আশাকে জোরদার করে এবং সংকল্প ও দৃঢ়তাকে শক্তিশালী করে। একইসঙ্গে মুসলিম বিশ্বের নানা সমস্যা; বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা,রাজনৈতিক পরনির্ভরতা,অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা আমাদেরকে বড় ধরণের দায়িত্ব ও নিরলস সংগ্রামের দিকে আহ্বান করে। দখলীকৃত ফিলিস্তিন আমাদের সহায়তা চায়,নিপীড়িত ও রক্তে রঞ্জিত ইয়েমেন আমাদের হৃদয়-মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, আফগানিস্তানের দুর্দশা আমাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দেয় এবং ইরাক,সিরিয়া ও লেবাননসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে আমেরিকা ও এর সহযোগীদের হস্তক্ষেপে যেসব তিক্ত ঘটনা ঘটছে তা তরুণদের ভেতরে নির্ভীকতা ও সাহস জাগ্রত করে।
অন্যদিকে স্পর্শকাতর অঞ্চলে প্রতিরোধ শক্তির উত্থান,জাতিগুলোর জাগরণ এবং তরুণ ও প্রাণবন্ত প্রজন্মের উদ্যম মানুষকে ব্যাপকভাবে আশাবাদী করে তোলে;ফিলিস্তিন তার সব প্রান্ত থেকেই সোর্ড অব কুদস প্রদর্শন করছে, বায়তুল মুকাদ্দাস,গাজা,পশ্চিম তীর,১৯৪৮ সালের ভূখণ্ড ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে,তারা ১২ দিনের যুদ্ধে শত্রুদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। অবরুদ্ধ ইয়েমেন সাত বছর ধরে নির্দয় ও নির্মম শত্রুদের যুদ্ধ,নৃশংসতা ও অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে এবং খাদ্য ও ওষুধসহ জীবনোপকরণের সংকট মোকাবেলা করছে,কিন্তু অত্যাচারীদের কাছে মাথানত করছে না। তারা সাহস ও দৃঢ়তার মাধ্যমে শত্রুদের ভেতরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ইরাকে প্রতিরোধ শক্তি দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসর আইএস-কে পিছু হটিয়ে দিচ্ছে। তারা আমেরিকা এবং এর সহযোগীদের যে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ ও অন্যায়ের মোকাবেলায় নিজেদের দৃঢ়তার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করছে।
আমেরিকা প্রচারণার মাধ্যমে ইরাক,সিরিয়া,লেবানন ও অন্যান্য দেশের সাহসী যুবসমাজ ও প্রতিরোধ শক্তির উদ্যম,দৃঢ়তা ও পদক্ষেপগুলোকে বিকৃতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তারা ইরান বা অন্য কারো সঙ্গে তাদেরকে সম্পর্কযুক্ত করে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমেরিকার এ ধরণের অপতৎপতা এই সাহসী ও সচেতন যুবকদের প্রতি অবমাননার শামিল। মার্কিনীরা এমনটা করছে কারণ তারা এই অঞ্চলের জাতিগুলোকে চিনতে ও বুঝতে পারেনি।
এ ধরণের ভুল উপলব্ধি ও অজ্ঞতার কারণে আমেরিকা আফগানিস্তানে লাঞ্ছিত হয়েছে। বিশ বছর আগে তারা সেখানে হৈ-হুল্লোড় করে প্রবেশের পর নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বোমা ব্যবহার করতে থাকে। এরপর বুঝতে পারে তারা আসলে চোরাবালিতে আটকা পড়ে গেছে। এখন তারা সেনাবাহিনী ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছে। অবশ্য সচেতন আফগান জাতিকে অবশ্যই সেদেশে মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সফ্ট ওয়ার বা কোমল যুদ্ধের সরঞ্জাম সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে ও এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রমাণ করেছে যে,তারা সজাগ ও সতর্ক রয়েছে এবং তাদের নীতি ও পন্থা সেই সব সরকারের চেয়ে আলাদা যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট রাখতে ফিলিস্তিনের মতো সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও মাথানত করছে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে দখলদার ইহুদিবাদী সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক অধিকারকে অস্বীকার করছে। এটা ডাকাতি। তারা নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি,এখন ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার,সম্পদ ও পুঁজি লুটপাটে নেমেছে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা!
আমাদের এই অঞ্চল এবং এখানকার বিচিত্র ঘটনা শিক্ষা ও উপদেশের এক প্রদর্শনী। একদিকে বলদর্পী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধের ফলে অর্জিত শক্তি ও ক্ষমতা আর অন্যদিকে আত্মসমর্পণ,দুর্বলতা প্রকাশ ও চাপের কাছে নতিস্বীকারের কারণে সৃষ্ট লজ্জা ও অপমান।
আল্লাহর আন্তরিক প্রতিশ্রুতি হচ্ছে তার পথে সংগ্রামকারীদের বিজয়: ‘যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দেবেন।’ ইনশাআল্লাহ এই সংগ্রামের প্রথম অর্জন হবে মুসলিম দেশগুলোতে আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক বলদর্পীদের হস্তক্ষেপ ও অপকর্মের অবসান।
আমি মহান আল্লাহর কাছে মুসলিম জাতিগুলোর বিজয় কামনা করছি এবং হজরত ইমাম মাহদি (আ.)-এর প্রতি দরুদ পাঠাচ্ছি। একইসঙ্গে মহান নেতা ইমাম খোমেনী ও শহীদদের উচ্চ মর্যাদার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।
ওয়াসসালামু আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহিন
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী (হাফিঃ)