হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, যদি প্রশ্ন করা হয়, 'মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারিত্ব, রক্তপাত, গুপ্তহত্যা, যুদ্ধসহ যাবতীয় অশান্তির মূল হোতা কে?' সবাই এক বাক্যে উত্তর দিবে ইহুদিবাী ইসরায়েল।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ড জবর-দখল করে নেয়ার পর থেকে শুরু। এরপর ইহুদিবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের একের পর এক দেশের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। গত মে মাসে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সাথে ১২ দিনের যুদ্ধ বাঁধানোর পর পরাজয় মেনে নিয়ে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করেছিল ইসরায়েল।
সরলমনা কেউ কেউ হয়ত ভেবে নিয়েছিল- ইসরায়েল এবার হয়ত আর যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু না, যুদ্ধবাজ অবৈধ রাষ্ট্রটি গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ লেবাননে বিমান হামলা চালিয়েছে, পাল্টা জবাবে গতকাল শুক্রবার, লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে অন্তত ২০ টি রকেট হামলা চালিয়েছে।
এর আগে ওই এলাকায় ব্যাপকভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করেছে ইহুদিবাদী সেনারা। গত বুধবার, ইসরাইলের অভ্যন্তরে লেবানন থেকে তিনটি রকেট হামলা হয়েছে বলে দাবি করে- ইসরাইল এই ব্যাপক বিমান হামলা ও কামানের গোলাবর্ষণ করল।
ফিলিস্তিনের কয়েকটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালের দিকে ইসরাইলি বিমান থেকে দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালায়। হামলার কথা নিশ্চিত করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। তারা দাবি করেছে, দক্ষিণ লেবাননের যেসব এলাকাকে রকেট উৎক্ষেপণের লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল সেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে। বিমান হামলার আগে ইসরাইলি সেনারা দক্ষিণ লেবাননে কামানের অন্তত ১০০ রাউন্ড গোলাবর্ষণ করে।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের ঐ বিমান হামলার জবাবে লেবাননের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ শুক্রবারে ২০ টি রকেট হামলা চালিয়েছে।
হিজবুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অধিকৃত শেবা ফার্ম এলাকায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেনা অবস্থান লক্ষ্য করে এসব রকেট হামলা চালানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল সোয়া এগারোটার দিকে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ১২২ ক্যালিবারের অন্তত ২০টি রকেট ছোঁড়ে।
লেবাননের আল মায়াদিন টেলিভিশন চ্যানেল এ খবর নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে, আল-মানার টেলিভিশন জানিয়েছে, দাউফ সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে এসব রকেট ছোঁড়া হয়।
লেবাননের নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, লেবাননের শিবা শহরের আল-আরকুব এলাকা থেকে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। রকেট ছোঁড়ার পরপরই ইসরাইল অধিকৃত গোলান উপত্যকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সাইরেনের শব্দ শোনা যায়।
ইসরাইলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলের লোকজনকে ঘরের মধ্যে থাকতে বলা হয়েছিল । রকেট হামলার পর ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ও যুদ্ধমন্ত্রী বেনি গান্তজ জরুরি বৈঠকে বসেন।
আল-জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল জানিয়েছে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী লেবাননের কাফর শুবা পাহাড়ি এলাকায় বিমান হামলা চালায় এবং ফসফরাস বোমাবর্ষণ করে। সেখানকার ফসলের ক্ষেতে আগুন ধরে যায়। ইহুদিবাদী ইসরাইল দীর্ঘ ১৫ বছর পর দক্ষিণ লেবাননের কয়েকটি গ্রামে বিমান হামলা চালানোর দুঃসাহস দেখায়। ওই হামলার জবাবে হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো। হিজবুল্লাহর এই পাল্টা হামলাকে সমর্থন জানিয়েছে ইয়েমেনের প্রতিরোধ সংগঠন আনাসরুল্লাহ সহ ইসরায়েল-বিরোধী কয়েকটি সংগঠন।
যুদ্ধ বিরতি ভঙ্গ করে দীর্ঘ ১৫ বছর পর ইসরায়েল কেন লেবাননে বিমান হামলা চালালো?
লেবাননে এখন চলছে এক জটিল পরিস্থিতি। আর এ সময়ই সেখানে হামলা চালিয়ে ইসরাইল হিজবুল্লাহর অবস্থানকে দুর্বল করতে চাইছে বলে অনেকেই মনে করছেন। গত বছর, বৈরুতে মহা-বিস্ফোরণের বার্ষিকী উপলক্ষে ওই ঘটনার যথাযথ তদন্ত না হওয়ায় অনেকেই প্রতিবাদ মিছিল করেছে। ওই বিস্ফোরণের পরপরই সৌদি ও ইসরাইলি মিডিয়াগুলো হিজবুল্লাহকে দায়ী করে ও লেবাননে হিযবুল্লাহ বিরোধী মনোভাব উসকে দেয়ার চেষ্টা করে। এখন ওই বিস্ফোরণের বার্ষিকী উপলক্ষে লেবাননের কোনো কোনো অঞ্চলে ইরান ও হিযবুল্লাহর নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর বিরোধী শ্লোগান দিয়ে পরিকল্পিত সহিংসতা ঘটিয়েছে একদল জনতা। ঐ জনতার পেছনে আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরায়েলের চক্রান্ত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আর ইসরাইলি যুদ্ধবাজ নেতারা ভাবছে অন্যের ঘরে ঢিল মারার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কিন্তু ইসরাইলি সামরিক বিশ্লেষকরা হিজবুল্লা'র প্রবল প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় বলেছেন, দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলি হামলার লক্ষ্য বা টার্গেট হিজবুল্লাহ নয় এবং ইসরাইলি নিরাপত্তা বিভাগগুলো মনে করে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরাইলে রকেট নিক্ষেপের ঘটনাতেও হিজবুল্লাহ জড়িত নয়, তাই হিজবুল্লাহকে টার্গেট করে হামলা করা হয়নি। ইসরাইলের কথিত পাল্টা হামলা কেবল সতর্ক সংকেত মাত্র।
যাই হোক ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননের গ্রামে হামলা চালিয়ে ২০০৬ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ঘোষিত যুদ্ধ-বিরতি সংক্রান্ত ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব লঙ্ঘন করেছে। আর তাই লেবানন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইসরাইলের এই নতুন আগ্রাসন অত্যন্ত বিপজ্জনক ও তা দক্ষিণ লেবাননের সীমান্ত এলাকার শান্ত অবস্থার জন্য হুমকি। লেবাননের আকাশ সীমা ব্যবহার করে ইসরাইল সিরিয়ায় প্রায়ই যেসব বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে এসেছে বিগত কয়েক বছরে তারই প্রেক্ষাপটে ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননে এসব হামলা চালাল বলে হাসান দিয়াব উল্লেখ করেছেন।
এদিকে গত সপ্তাহে, ইসরাইলি তেল ট্যাংকারে হামলার অভিযোগে ইরানে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের যুদ্ধমন্ত্রী বেনি গান্তজ। সংবাদ মাধ্যমে কথা বলার সময় ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা দেন। ইসরাইলের যুদ্ধমন্ত্রী ওয়াই নেটকে ওয়েবসাইটকে বলেন, "ইরানসহ কয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত রয়েছে তেল আবিব। তিনি তার ভাষায় বলেন, “ইরান হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমস্যা; এটি ইসরাইলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।”
ইসরায়েলের যুদ্ধমন্ত্রীর হুমকির জবাবে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেন, ''যে সমস্ত দেশ ইরানকে হুমকি দেয় তাদেরকে বিশেষ করে ইসরাইলকে ইরানের আত্মরক্ষা ও হামলা চালানোর সক্ষমতার বাস্তবতা বুঝতে হবে।" তিনি বলেন, “শত্রুর কোনো ধরনের হামলা সহ্য করার নীতি ইরানের সামরিক কৌশলে নেই।” তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, শত্রুর যেকোনো ধরনের হামলার তাৎক্ষণিক ও শক্তিশালী জবাব দেবে ইরান।
জেনারেল সালামি পরিষ্কার করে বলেন, "যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত।" তিনি আরো বলেন, "তার এসব কথা কোনো কূটনীতি নয় বরং আ্যকশন।"
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খাতিবজাদে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, "যেকোনো বোকামিপূর্ণ কাজের জন্য ইসরাইল এবং তার মিত্রদেরকে চূড়ান্ত জবাবের মুখে পড়তে হবে। তিনি বলেন, “আমাদেরকে পরীক্ষা করবেন না।”
যাইহোক, ইসরাইলি আগ্রাসনের বিষয়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব মোড়লরা যদি নীরব থাকে তাহলে তা পশ্চিম এশিয়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এবং এ অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধ ও সহিংসতার দামামা বেজে উঠতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
লেখা: রাসেল আহমেদ রিজভী