হাওজা নিউজ বাংলা এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী, হায়, হায়! মঞ্চ প্রস্তুত। দিনতারিখ নির্ধারিত হয়ে আছে পূর্ব থেকেই। সংবাদ পৌঁছে গেছে জন্মলগ্ন থেকেই। সংবাদদাতা জিবরাঈল আলাইহিস সালাম। সংবাদ গ্রহীতা নানাজান সরকারে দু’জাহান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম। উপস্থিত উম্মুল মুমেনীন উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। শিশু হুসাইনকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন নানাজান। যে কারো জন্মই আনন্দের। কিন্তু এ আনন্দের সাথে বেদনা মিশ্রিত হয়ে গেছে। নানাজান জেনে ফেলেছেন তাঁর উম্মতেরই কিছু লোক এই আওলাদকে একদিন নির্মমভাবে শহীদ করবে। জিবরাঈল এই সংবাদের সাথে শাহাদতের স্থানের একটুখানি মাটিও নিয়ে এসেছেন। সে মাটি হাতে নিয়ে কাঁদছেন ইমামুল মুরসালীন। তাঁর সুশোভিত পবিত্র শ্মশ্রু ভিজে গেছে অশ্রুতে। কমোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে অশ্রু। উম্মুল মুমেনীন জানতে চাইলেন, কেন আনন্দের মুহূর্তে এ কান্না! সরদারে দু’আলম আসল রহস্য জানালেন। রহস্য জেনে নির্বাক হলেন উম্মুল মুমেনীন। এই বাচ্চাকে কতল করবে উম্মতেরই একদল লোক? হায় হায়! তাও কি সম্ভব?
সে সংবাদ শুনে কেঁদেছিলেন আম্মাজানও। আব্বাজানও কেঁদেছিলেন। তিনি আরেকবার কেঁদেছিলেন, যখন এ পথ দিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে সিফফিনের দিকে যাচ্ছিলেন। এ অঞ্চলের নাম শুনে তিনি কেঁদেছিলেন। তাঁর হুসাইন যে এখানেই শাহাদত বরণ করবেন! সেদিনও সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ফোরাতের পানি বন্ধ করে রেখেছিল। আজও পানি বন্ধ। হায় হায়! ইতিহাস ঘুরে ফিরে আসে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু কেউ তা গ্রাহ্য করে না। সেদিন বাবাজান মওলা আমি আলাইহিস সালাম শত্রুদের থেকে ফোরাতের পানি মুক্ত করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আজও আবার ফোরাতের পানি অবরুদ্ধ। আহলে বাইত এবং ইমাম শিবির পিপাসার্ত। এক ফোটা পানি নেই তাঁবুতে।
সে পানি মুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হচ্ছেন আহলে বাইতের পবিত্র রাজকুমারগুলো। আব্বাস আলমদার জেদ ধরে ফোরাতের দিকে গিয়েছিলেন। আহলে বাইতের শিশু এবং মহিলাদের জন্যে একটু পানি আনবেন। প্রতিপক্ষ মুসলমান শত্রুদের তীরের আঘাতে জর্জরিত হলেন। তারা তাঁকে থামাতে পারলো না। যে হাতে পানি ধরে ছুটছিলেন ইমাম শিবিরের দিকে, সে হাত তরবারির আঘাতে ছিন্ন হল। তবু থামাতে পারলো না তাঁকে। তিনি ছুটছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। অন্য হাতে পানির মশক ধরে। শত্রুরা সে হাতও তরবারি দিয়ে ছিন্ন করে ফেলল। বাধ্য হয়ে তিনি দাঁতে কামড় দিয়ে ছুটছেন পানি নিয়ে। শিবিরের শিশুরা কাঁদছে পানির পিপাসায়। এবার সে পবিত্র মাথাও আলাদা করে পানি ঠেকিয়ে দিল শত্রুরা। উদ্দেশ্য ইমাম শিবিরে যেন পানি না পৌঁছে। হায় হায়! তারাও মুসলমান। নামাযে যাঁদেরকে এরা সালাম দিতে বাধ্য সেই পবিত্র লোকগুলোকেই তারা পানির পিপাসায় কষ্ট দিয়ে মারতে উদ্যত। ফোরাতের পানি কতো মানুষই তো পান করে যায়। পশুপাখি, পথিক, সাধু, অসাধু সবার জন্যই ফোরাতের পানি উন্মুক্ত। কিন্তু সে পানি আহলে বাইতের জন্য নিষিদ্ধ হল। আহ!
পানির জন্য শিশু আজগরও ছটফট করছিলেন। ইমাম নিয়ে গেলেন শিশু আজগরকে ফোরাতের তীরে। শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে। তারা কেউ কাছে আসতে সাহস করলো না। কিন্তু দূর থেকে তীর ছুড়তে দ্বিধা করলো না নাপাক পাপিষ্ঠ মুসলমানরূপী মানুষগুলো। তাদের ছোড়া তীর গিয়ে লাগলো শিশু আজগরের বুকে। আহলে বাইতের শিশুরাও এজিদী বাহিনীর নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ কেমন নিষ্ঠুরতা?
আসাদুল্লাহ, আল্লাহর ব্যাঘ্র খ্যাত বাবা বিদায় নিয়েছেন ২০ বছর হল। শাহাদাতের বিদায়। বড় ভাইও গত হয়েছেন ১০ বছর আগে। তাঁর বিদায়ও শাহাদাতের। এবার তাঁর পালা। আহলে বাইতের সবার বিদায়ের সংবাদ আগে থেকেই রাসুল-অনুপম [দঃ] দিয়ে গেছেন। তাই মঞ্চ প্রস্তুত।
সেই অমোঘ মুহূর্ত উপস্থিত। তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে এজিদী সেনারা। অন্যদিকে আহলে বাইতের শিবির। সেখানে নারী ও শিশুরা অবস্থান করছেন। দূর থেকে নরাধম কাপুরুষেরা মাঝে মাঝে তীর ছুড়ছে। তীরের মাথায় আগুন। সে আগুনে আহলে বাইতের শিবির প্রজ্বলিত হচ্ছিল। নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত। ইমাম হুসাইন রাতেই পরিবারের সবাইকে চলে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে ছেড়ে একজনও যান নি। তারা মৃত্যুকে হাসি মুখেই বরণ করে নেবার পণ করেছেন। যাদের হাতে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত এ ইমাম শিবির তারা নানাজানেরই উম্মত। নামাযী, পাগড়ীওয়ালা, মুখে দাড়ি এবং গায়ে জুব্বা। নামে মুসলমান। দেখতেও মুসলমান। তবে সমস্যা ভেতরে।
শিবিরের ৭২ জন পুরুষ সদস্য তাঁর চোখের সামনেই একে একে বীরত্বের সাথে প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু মান দেননি। এদের মধ্যে আহলে বাইতেরই ১৮ জন। একমাত্র পুরুষ সদস্য আলী ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শিবিরে অসুস্থ শুয়ে আছেন। শিশুদের মধ্যে দুএকজন ছেলেও ছিলেন। শিবিরের বাকি সব নারী ও শিশুমেয়ে। তাঁরা একে একে নিজেদের প্রাণপ্রিয় মুখগুলোকে এজিদী বাহিনীর তীর, বল্লম ও তরবারির আঘাতে প্রাণ হারাতে দেখেছেন। মৃত্যুর আগেই যেন বারবার অসহ্য মৃত্যুযন্ত্রণা। নারী আর শিশুদের চিৎকার আর মাতমে কারবালার প্রান্তর ভারি হয়ে উঠলেও সিমারের কঠিন বক্ষ তা ভেদ করে না। কারবালার এ করুণ দৃশ্যে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠলেও এজিদী বাহিনীর অন্তর কাঁপে না।
এবার ইমাম হুসাইনের পালা।
তিনি তাঁবু থেকে বাইরে এলেন। শত্রুসৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। চতুর্দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন। চারপাশে জুব্বা, পাগড়ী পরা মানুষ। এরা তাঁর নানাজানেরই উম্মত। একটু আগে এরাও জামাতে নামায আদায় করেছে। ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামও তার অবশিষ্ট সাথীদের নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় জুমা আদায় করেছেন। জীবনের শেষ জুমা। সালাতুল খাওফ। ভয়ের সময়ে নামায। নামায অবস্থায়ও শত্রুদের তীর আর আক্রমণ বন্ধ ছিল না।
তিনি চিৎকার করে জানতে চাইলেন, “কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোন পাপ অথবা অপরাধ করেছি?” এজিদের সৈন্য বাহিনী বোবার মত দাঁড়িয়ে রইল। পুনরায় ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “আমাকে হত্যা করলে আল্লাহ্র কাছে কি জবাব দেবে? কি জবাব দেবে বিচার দিবসে নানাজানের কাছে?” এবারো এজিদের সৈন্য বাহিনী পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর তিনি সে করুণ কথাটি উচ্চারণ করলেন। “হাল্ মিন্ নাস্রিন ইয়ানসুরুনা? আমাদের সাহায্য করার মত কি তোমাদের মাঝে একজনও নাই?” হায় হায়! কত ভয়ংকর পরিস্থিতি হলে একজন বীরের পক্ষে এমন কথা উচ্চারণ করা সম্ভব? চারপাশে যারা তারা তো তাঁর নানাজানেরই উম্মত। কিন্তু কিসের তাড়নায় এবং কিসের লোভে তারা আজ তাদের জান্নাতের সরদারকে হত্যা করতে উদ্যত? চোখের সামনে একে একে সবাই প্রাণ দিয়েছেন। তাঁবুতে অসহায় নারী আর শিশুরা চিৎকার আর মাতমে আকাশ ভারি করে চলেছে। ইমাম জানেন অন্যান্যদের মতো তাঁর অবস্থাও একই হবে। এজিদী বাহিনীর উদ্দেশ্য তাঁকে শহীদ করা। এজিদের পথ কণ্টকমুক্ত করা। তিনি শিবিরে নারীদের দিকে তাকালেন, শিশুদের কান্না দেখলেন, চিৎকার দেখলেন, নারীদের মাতম লক্ষ্য করলেন। আহলে বাইতের পবিত্রা নারীগণ কাঁদছেন। আহলে বাইতের নিষ্পাপ শিশুরা গড়াগড়ি করে কাঁদছে। তাঁদের শোকে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে এসেছে। তিনি শিশু ও নারীদের নিয়ে চিন্তা করলেন। অসুস্থ আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথা ভাবলেন। জয়নুল আবেদীন যাঁর উপাধি। নারীদের সম্ভ্রম আর শিশুদের জীবন নিয়ে চিন্তিত হলেন। ৪ বছরের সুকায়নার ধুলিমাখা মুখখানি কল্পনা করলেন। গত রাতেও যে তাঁর বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। আজ থেকে কার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে তাঁর সুকাইনা? হায় হায়!
তারপরের আহ্বানটি আরো মারাত্বক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামের সর্বশেষ আহ্ববান।
“আলাম্ তাস্মাও? আলাইসা ফিকুম্ মুসলিম?”
“আমার কথা কি শুনতে পাও না? তোমাদের মাঝে কি একজনও মুসলমান নাই?” একজন লোকও কোনও উত্তর করেনি সেদিন। তারা নির্দয় আর পাষাণ হৃদয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইমামের উপর। এরপরের ঘটনা আরো দীর্ঘ। সেদিকে না যাই। পবিত্র মস্তকগুলো, তাঁদের পবিত্র দেহগুলো। শিবিরের নারী ও শিশুগুলো। অসুস্থ জয়নাল আবেদীন। জয়নাব বিনতে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। নবীপরিবারের সম্ভ্রম। ইবনে জিয়াদের কারাগার। কুফার গলিতে নবীপরিবারের পবিত্রা নারীগণের বেপর্দা করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দামেস্কে প্রেরণ এবং দামেস্কের বাইরে চারদিন অপেক্ষা করা। কারণ এজিদ এমন বিজয়ে দামেস্ক শহর সাজাতে ব্যস্ত। তার উৎসবের দিন। আহ! নবীজী বলতেন, আমার আহলে বাইত, আমার আহলে বাইত, আমার আহলে বাইত। সে কথা যেন বাতাসে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে।
সেদিনও আহলে বাইতের পক্ষে লোকজন কম ছিল আজো ঠিক তাই। কিয়ামত পর্যন্ত এরকমই থাকবে। আফসোস, তারপরও আমরা মুসলমান!
লেখাঃ ডক্টর আব্দুল বাতেন মিয়াজী