হাওজা নিউজ বাংলা রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতবর্ষের মুসলিম শাসকরা ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছে ক্ষমতা হারিয়েছিল। তাই রাজনৈতিকভাবে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে পরাজিত রাজশক্তি হিসেবে মুসলিমদের দূরত্ব ছিল।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসকদের ইউরোপীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও আইন চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা এই দূরত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে একদিকে আলেমরা যেমন ব্রিটিশদের সামনে অনমনীয় ছিলেন, অন্যদিকে ব্রিটিশরা জেল, জুলুম, অত্যাচার ও ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিল। তবে রাজনৈতিক এই বিরোধ আলেমদের ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা ও দ্বিনি আমানত রক্ষার জায়গা থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি।
দেওবন্দি ধারার আলেমদের ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে এই প্রচার আছে যে তারা একসময় ইংরেজি শেখাকে হারাম বলেছিলেন। তবে প্রামাণ্য সত্য হলো আলেমদের ব্যাপারে এটি একটি অপপ্রচার ছাড়া কিছুই না।
এটা ঠিক যে ইংরেজদের কৃষ্টি-কালচার এবং সমাজ ও সভ্যতার প্রভাব তাদের ভাষাতেও আছে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে ভাষা একটি মাধ্যম ছাড়া কিছুই না। যেমন একটি লাঠি অত্যাচারী ব্যক্তির হাতে থাকলে মানুষ অত্যাচারের শিকার হয়, পক্ষান্তরে বিচারকের হাতে থাকলে দুষ্টের দমন হয়। (দারুল উলুম দেওবন্দ)
ইতিহাস বলে, ইসলাম সব ভাষার সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণই করেছে। যেমন ফারসি ভাষা অগ্নি উপাসকদের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হলেও আলেমরা যখন এ ভাষার নিয়ন্ত্রণ হাতে পেলেন, তখন ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম বানালেন।
ইসলামী ভাষা আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা নিছক ভাষা হিসেবে গ্রহণীয়ও নয়, বর্জণীয়ও নয়। তা একটি বাহন বা মাধ্যমমাত্র। এ জন্য শুধু ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার বিরোধিতা আলিমরা করবেন তা যুক্তিসংগত নয়; বরং তা বাস্তবতাবিরোধী। দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.) ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করে একে দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন। যা নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা স্পষ্ট হয়—‘দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা শেষ জীবনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যে আমি যদি ইংরেজি জানতাম তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে তোমরা যাকে জ্ঞান মনে করো তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হলো যা নবীদের (আ.) সিনা থেকে বেরিয়ে আলোকিত অন্তরে এসে অবস্থান নিয়েছে। (আর-রাশিদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)
মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) এক প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, ‘ইংরেজি ভাষা শেখা জায়েজ।’ (ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া, পৃষ্ঠা ৫৭৪)
এ ছাড়া মাওলানা কাসিম নানুতবি (রহ.)-এর সমসাময়িক বিখ্যাত আলেম মাওলানা আবদুল হাই লাখনুভি (রহ.) লেখেন, ‘ইংরেজি পড়া ও ইংরেজি শেখা জায়েজ, যদি এতে দ্বিনদারির ক্ষতি না হয়।’ (ফাতাওয়ায়ে মাওলানা আবদুল হাই লাখনুভি : ২/২৩৩)
শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) ১৯২০ সালে মাল্টার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘উলামায়ে কেরাম কখনো ইংরেজি ভাষায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষেধ করেননি।’ (আর রাশিদ, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৬৬০)
আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) ইংরেজি পড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, ‘অন্যান্য ভাষার মতো ইংরেজিও একটি নির্দোষ ভাষা; কিন্তু আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কারণে তা দোষযুক্ত হয়...। যদি কেউ সেসব অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত থাকে অর্থাৎ তার আকিদা-বিশ্বাস বিনষ্ট না হয়, যার সহজ এবং একমাত্র পথ হচ্ছে ইলমে দ্বিন অর্জনের ইচ্ছা চিন্তা-চেতনায় তা বদ্ধমূল রাখা এবং আমল-আখলাকও যেন নষ্ট না হয়। সঙ্গে সঙ্গে এই সংকল্পও থাকে যে এর দ্বারা জীবিকা উপার্জনের শুধু এমন পথ অবলম্বন করব, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ। অতঃপর কার্যক্ষেত্রেও এ নীতির ওপর অটল থাকে, তো এমন ব্যক্তির পক্ষে ইংরেজি শেখা জায়েজ ও নির্দোষ। আর যদি নিয়ত এই থাকে যে একে দ্বিনের খেদমতের জন্য ব্যবহার করবে, তবে তা ইবাদত বলে গণ্য হবে...।’
শেষকথা এই যে আমাদের পূর্বসূরিরা কোনো ভাষার বিরোধিতা নিছক ভাষা হিসেবে করেননি। একইভাবে পার্থিব জ্ঞানার্জনেও মানুষকে বাধা দেননি। তারা ইংরেজি শেখার নয়, ইংরেজি ভাবাপন্ন হওয়ার বিরোধিতা করেছেন। চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস, শিষ্টাচার ও জীবনাচারে প্রতিটি মুসলমানের জন্য আল্লাহর আনুগত্য করা আবশ্যক। আর ইউরোপীয় শিক্ষা যেন মুসলিম শিশুদের ইসলামী জীবনযাপন থেকে সরিয়ে পশ্চিমা জীবনাচারে অভ্যস্ত না করে এ জন্য আলেমরা সতর্ক করেছিলেন।