মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
১৫ রমযান হযরত রাসূলুল্লাহর ( সা.) সিবতে আকবর ( জৈষ্ঠ্য দৌহিত্র ) ইমাম হাসান মুজতাবার (আ.) শুভ জন্মদিন উপলক্ষ্যে :
মহানবী সা.) তাঁর দুই দৌহিত্র ইমাম হাসান ( আ.) ও ইমাম হুসাইনকে ( আ.) এ পৃথিবীতে তাঁর দুটো সুগন্ধযুক্ত পুষ্প ( রাইহানা ) বলে অভিহিত করেছেন । সহীহ বুখা্রীতে বর্ণিত হয়েছে :
قَالَ النَّبِيُّ - ص- : هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنَ الدُّنْيَا
মহানবী (সা.) : তারা দুজন ( ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ) হচ্ছে পৃথিবীতে আমার দুটো সুগন্ধযুক্ত পুষ্প ( রাইহানা ) । ( দ্র : সহীহ বুখারী , হাসান ও হুসাইনের - রা: - মানাক্বিব অধ্যায় , হাদীস নং ৩৭৫৩ , পৃ : ৯১৭ )
মহানবী (সা:) ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন সম্পর্কে বলেছেন :
وَ قَالَ -ص- : اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا وَ أَحِبَّ مَنْ يُحِبُّهُمَا .
হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই আমি তাদের কে ( হাসান ও হুসাইন ) ভালোবাসি ; তাই আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন এবং যারা তাদেরকে ভালোবাসে আপনি তাদেরকেও ভালোবাসুন । ( দ্র : আল - ইস্তীয়াব , খ : ২ , পৃ : ২৩৪ )
আবূ হুরায়রা ( রা:) বলেন : মহানবী ( সা:) হাসান ও হুসাইন কে সাথে নিয়ে আমাদের কাছে আগমন করলেন ; হাসান তাঁর এক কাঁধে এবং হুসাইন তাঁর অন্য কাঁধে ছিলেন । আর তিনি একবার হাসানকে আরেক বার হুসাইন কে চুম্বন করছিলেন । আর এভাবে তিনি ( সা.) আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন । তখন এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল : হে রাসূলুল্লাহ ( সা:) আপনি কি এ দুজনকে ভালোবাসেন ? তখন তিনি ( সা.) বললেন : হ্যাঁ , যে ব্যক্তি তাদের দুজনকে ( হাসান ও হুসাইন ) ভালোবাসে সে আমাকেই ভালোবাসে এবং যে ব্যক্তি তাদের দুজনকে ঘৃণা করে সে আমাকেই ঘৃণা করে ।
( হাকিম নিশাপুরী বলেন : ) এটি সহীহুল ইসনাদ হাদীস এবং বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি ।
আল্লামা যাহাবী তার আত তালখীস গ্রন্থে তার ( হাকিম নিশাপুরী ) সাথে এক মত পোষণ করে বলেছেন : ( এ হাদীসটি ) সহীহ । ( দ্র : আল - মুস্তাদ্রাক আলাস সহীহাইন , খ : ৩ , পৃ : ৩৭৬ , হাদীস নং ৪৮৩৮ )
٤٨٣٨ - عن أبي هريرة - رض - ، قَالَ : خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللّٰهِ - ص- وَ مَعَهُ الْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ ، هٰذَا عَلَىٰ عَاتِقِهِ، وَ هٰذَا عَلَىٰ عَاتِقِهِ وَ هُوَ يَلْثمُ هٰذَا مَرَّةً وَ هٰذَا مَرَّةً ، حَتَّى انْتَهَىٰ إِلَيْنَا ، فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ : يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ إِنَّكَ تُحِبُّهُمَا ؟ فَقَالَ : نَعَمْ ، مَن أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِيْ ، وَ مَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِيْ . هٰذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحُ الْإِسْنَادِ وَ لَمْ يُخرِجَاهُ.
٤٨٣٨ - وَافَقَهُ الذَّهَبِيُّ فِي التَّلْخِيْصِ : صَحِيْحٌ.
সালমান ( রা.) বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি : হাসান ও হুসাইন আমার দুই পুত্র সন্তান ( দৌহিত্র ) । যে ব্যক্তি তাদের দুজনকে ভালোবাসে সে আমাকে ভালোবাসে , আর যে আমাকে ভালোবাসে মহান আল্লাহ তাকে ভালোবাসে , আর যে ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ ভালোবাসে তাকে তিনি ( আল্লাহ ) বেহেশতে প্রবেশ করাবেন ; আর যে ব্যক্তি তাদের দুজনকে ঘৃণা করে , সে আমাকে ঘৃণা করে , যে আমাকে ঘৃণা করে মহান আল্লাহ তাকে ঘৃণা করেন এবং যাকে মহান আল্লাহ ঘৃণা করেন তাকে তিনি ( আল্লাহ পাক ) দোযখে প্রবেশ করাবেন ।
( হাকিম নিশাপুরী বলেন:) এ হাদীসটি শাইখাইনের ( বুখারী ও মুসলিম ) শর্তে সহীহ এবং তারা দুজন (বুখারী ও সহীহ) তা বর্ণনা করেন নি । তবে আল্লামা যাহাবী তার আত - তালখীস গ্রন্থে বলেছেন : এটা মুনকার হাদীস । আর এ হাদীসটি বাকী ইবনে মুখাল্লাদ যাদান থেকে , সালমান থেকে অপর এক দুর্বল সূত্রেও রেওয়ায়ত করেছেন । ( দ্র : আল - মুস্তাদ্রাক আলাস সহীহাইন , খ : ৩ , পৃ : ৩৭৬ , হাদীস নং ৪৮৩৭ )
عَنْ سَلْمَانَ - رض - قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللّٰهِ - ص- يَقُوْلُ : الْحَسَنُ وَ الْحُسَيْنُ ابْنَايَ ، مَنْ أَحَبَّهُمَا أَحَبَّنِيْ ، وَ مَنْ أَحَبَّنِيْ أَحَبَّه اللّٰهُ وَ مَنْ أَحَبَّهُ اللّٰهُ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ ، وَ مَنْ أَبْغَضَهُمَا أَبْغَضَنِيْ ، وَ مَنْ أَبْغَضَنِيْ أَبْغَضَهُ اللّٰهُ ، وَ مَنْ أَبْغَضَهُ اللّٰهُ أَدْخَلَهُ النَّارَ .
মুনকার হাদীস ঐ হাদীস যার রাবী ফাসিক অথবা এমন বিদ'আতপন্থী ( مبتدع ) যার বিদ'আত কুফর পর্যন্ত পৌঁছে যায় অথবা স্বীয় হাদীসের দ্বারা নিজ বিদ'আতের দিকে আহবান কারী ও তা প্রচারকারী অথবা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও যার বর্ণনাকৃত হাদীসটি মকবূল ( গ্রহণযোগ্য ) হাদীসের মুখালিফ ( পরিপন্থী ) অথবা যে গাফেল ( অসচেতন ) , গালিত্ ( ভ্রমকারী ) , ভুলে নিমজ্জিত ( নাসী ) অথবা অধিক দ্বিধা - সংশয় ও অমূলক ধারণা পোষণকারী ( কাসীরুল ওয়াহম ) ।
এ হাদীসটি কেন মুনকার হবে ? অথচ এ হাদীসটির মতনে ( মূল ভাষ্য বা text ) কোনো আপত্তি , অসুবিধা , বিদ'আত ও কুফর নেই । কারণ সহীহ সনদ সূত্রে প্রতিষ্ঠিত আছে : যে ব্যক্তি হাসান ও হুসাইন কে ভালোবাসে সে হরযত মুহাম্মাদকেই (সা.) ভালোবাসে এবং যে ব্যক্তি তাদের দুজনকে ঘৃণা করে সে হযরত মুহাম্মদকেই (সা.) ঘৃণা করে । আর এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে,
রাসূলুল্লাহকে (সা.) ভালোবাসা ও ঘৃণা করা আসলে মহান আল্লাহকেই ভালোবাসা ও ঘৃণা করা এবং মহান আল্লাহকে ভালোবাসা ও ঘৃণা করা বেহেশত ও দোযখে প্রবেশ করার কারণ । সুতরাং প্রমাণিত হয় যে হাদীসটির মতন সত্য ও সঠিক । আর রাবীদের ব্যাপারে আল্লামা যাহাবীর জারহ ও তাদীল ( সমালোচনা ও প্রশংসা - মূল্যায়ন ) গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেকেই আপত্তি করেছেন । কারণ , তিনি সূফী সম্প্রদায় ও আশ'আরীদের সমালোচনায় অধিক কঠোর ছিলেন । আর যারা অন্যের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করে , ডান পিটে , গোঁয়াড় ও সীমালংঘনকারী এবং অত্যধিক বাড়াবাড়ি প্রিয় , বিশেষ শহর বা এলাকাবাসীর উপর কিংবা বিশেষ কোনো আকীদা বা মাযহাবের লোকদের সমালোচনা করার ব্যাপারে সোচ্চার ও কঠোর এবং অতি সাম্প্রদায়িক শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব ও ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণকারী , রাবী সংক্রান্ত তাদের জারহ ( সমালোচনা ) গ্রহণযোগ্য নয় ( দ্র : আল্লামা মুফতী আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী বরকতী প্রণীত উসূলুল আসার আরবী বাংলা মীযানুল আখবার , পৃ : ৩৪ , প্রকাশক : আশরাফিয়া লাইব্রেরী , চৌমুহনী, নোয়াখালী ) ।
তাই হাদীসটির সনদে যদি সমস্যা থেকে থাকে তবে হাদীসটির অন্তর্নিহিত অর্থে সমস্যা নেই বরং তা বিশুদ্ধ সহীহ প্রতিষ্ঠিত সত্য হাদীস এবং ইসলামের অকাট্য মূলনীতিমালার আলোকে প্রতিষ্ঠিত সত্য ও সঠিক । তাই এর ফলে হাদীসটির অন্তর্নিহিত বিষয় ও অর্থে আর কোনো অসুবিধা ও আপত্তি বিদ্যমান থাকে না ।
উসামা ইবনে যাইদ ( রা:) বলেছেন : একরাতে আমি বিশেষ কিছু প্রয়োজনে মহানবীর ( সা:) বাসায় গিয়ে দরজায় টোকা দেই । তখন তিনি ( সা.)( দরজা খুললেন এবং ) আমার কাছে বের হয়ে আসলেন । আর এ অবস্থায় তিনি এমন কিছু পরে ছিলেন (বোঝার মতো একটা কিছু) যা আমি জানতাম না যে তা কী ? আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে আমি বললাম : আপনার সাথে এ জিনিসটা কী যা আপনি পরে আছেন ? অত:পর তিনি তা উন্মুক্ত করলে দেখা গেল যে হাসান ও হুসাইন তার কোমরের উপর দুই পাশে (বাঁধা) রয়েছেন । এরপর তিনি বললেন: এ দুজন ( হাসান ও হুসাইন ) আমার দুই পুত্র সন্তান এবং আমার কন্যার দুই পুত্র সন্তান । হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই আমি এ দুজনকে ভালোবাসি ; অতএব আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন এবং আপনি তাদেরকেও ভালোবাসুন যারা এ দুজনকে ভালোবাসে ।
قَالَ أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ : طَرَقْتُ النَّبِيَّ -ص- ذَتَ لَيْلَةٍ فِيْ بَعْضِ الْحَاجَةِ ، فَخَرَجَ إِلَيَّ وَ هُوَ مُشْتَمِلٌ عَلَىٰ شَيْءٍ لَا أَدْرِيْ مَا هُوَ ؟ فَلَمَّا فَرَغْتُ مِنْ حَاجَتِيْ قُلْتُ : مَا هٰذَا الَّذِيْ أَنْتَ مُشْتَمِلٌ عَلَىْهِ ؟ فَكَشَفَهُ فَإِذَا حَسَنٌ وَ حُسَيْنٌ عَلَىٰ وَرْكَيْهِ ،
فَقَالَ : هٰذَانِ ابْنَايَ وَ ابْنَا ابْنَتِيْ ، اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا، وَ أَحِبَّ مَنْ يُحِبُّهُمَا .
( দ্র : উসদুল ঘাবাহ্ ফী মা'রিফাতিস সাহাবাহ্ , খ : ১ , পৃ : ৫৫৮ )
আবূ হুরায়রা (রা:) বলেন : আমি
রাসূলুল্লাহকে ( সা :) যে আচরণ করার তা করতে দেখার পরে এ ব্যক্তিকে ( ইমাম হাসান ) এখনও ভালোবাসি । আমি মহানবীর ( সা.) কোলে হাসানকে দেখলাম যে তিনি নবী করীমের ( সা .) দাঁড়ির ভিতরে হাত ঢুকাচ্ছিলেন এবং মহানবী ( সা:)ও তাঁর জিহ্বা হাসানের মুখের ভিতরে প্রবিষ্ট করে বললেন : হে আল্লাহ ! নিশ্চয়ই আমি তাকে ভালবাসি ।
অতএব আপনিও তাঁকে ভালবাসুন ।
( হাকিম নিশাপুরী বলেন:) এ হাদীসটি সহীহুল ইসনাদ এবং বুখারী ও মুসলিম তা রেওয়াযত করেন নি ।
আল্লামা যাহাবী আত - তালখীস গ্রন্থে তাঁর ( হাকিম নিশাপুরী ) সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন : ( এ হাদীসটি ) সহীহ । ( দ্র : আল - মুস্তাদ্রাক আলাস সহীহাইন , খ : ৩ , পৃ : ৩৭৬ , হাদীস নং ৪৮৫২ )।
সাঈদ ইবনে আবী সাঈদ আল - মাকবেরী বলেন : আমরা আবূ হুরায়রার ( রা :) সাথে ছিলাম । অত:পর হাসান ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব আমাদের কাছে আসলেন এবং সালাম দিলেন । অত:পর আমরা তাঁকে সালাম দিলাম এবং আবূ হুরায়রা তাকে চিনতে না পারলে আমরা তাঁকে বললাম : হে আবূ হুরায়রা ! এ ব্যক্তি হাসান ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব আমাদেরকে সালাম দিয়েছেন । অত:পর তিনি ( আবূ হুরায়রা ) তার সাথে মিলিত হলেন এবং বললেন : আর আপনার উপরও সালাম হে আমার সাইয়েদ ( নেতা ) । তারপর তিনি বললেন : আমি রাসূলুল্লাহকে ( সা.) বলতে শুনেছি :
নিশ্চয়ই সে ( হাসান ) সাইয়েদ ( নেতা ) ।
( হাকিম নিশাপুরী বলেন :) এ হাদীসটি সহীহুল ইসনাদ এবং বুখারী ও মুসলিম তা রেওয়ায়ত করেন নি । আল্লামা যাহাবী আত তালখীস গ্রন্থে তাঁর (হাকিম নিশাপুরী) সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন : ( এ হাদীসটি ) সহীহ । ( দ্র : আল - মুস্তাদ্রাক্ আলাস সহীহাইন , খ:৩ , পৃ : ৩৭৯ , হাদীস নং ৪৮৫৩ ) ।… চলবে