মুহাম্মাদ মুনীর হুসাইন খান (মুহররম, ১৪৪৪ হি.)
পর্ব ১১- ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন - আলাইহিমাস সালাম বেহেশতের যুবকদের নেতা :
হযরত আবূ সাঈদ আল খুদরী ( রা:) বলেন : রাসূলুল্লাহ সা:) বলেছেন : হাসান ও হুসাইন বেহেশতবাসী যুবকদের নেতা । আমাদেরকে সুফিয়ান ইবনে ওয়াকী' বলেছেন । আমাদেরকে জারীর , মুহাম্মদ ইবনে ফুযাইল ইয়াযীদ থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন । আবূ ঈসা ( ইমাম তিরমিযী ) বলেন : এটি হাসান সহীহ হাদীস ।
(( এ হাদীসটি সহীহ , মুতাওয়াতির এবং শিআ - সুন্নী নির্বিশেষে সকল ইসলামী ফির্কা ও মাযহাবের কাছে গৃহীত ( মকবূল ) হাদীস । ))
( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৩১ : হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস সালামের মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৭৭ , পৃ : ৯৮৮ )
হযরত ইয়া'লা ইবনে মুররাহ বলেন : রাসূলুল্লাহ ( সা:) বলেছেন :
হুসাইন আমার থেকে এবং আমিও হুসাইন থেকে । যে হুসাইনকে ভালোবাসে মহান আল্লাহ তাকে ভালোবাসুক । হুসাইন একজন দৌহিত্র । আবূ ঈসা বলেন : এটা একটা হাসান হাদীস । ( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৩১ : হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস সালামের মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৮৪ , পৃ : ৯৯০ )
হযরত বারা ( রা :) বলেন : মহানবী ( সা:) হাসান ও হুসাইনের কে দেখে বললেন : হে আল্লাহ , আমি এদুজন কে ভালোবাসি অতএব আপনিও এ দুজনকে ভালোবাসুন । আবূ ঈসা বলেন : এটা হাসান সহীহ হাদীস । ( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৩১ : হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস সালামের মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৯১ , পৃ : ৯৯১ )
হযরত আবূ হুরায়রা ( রা:) বলেন : ..... এক ব্যক্তি তাঁকে ( রাসূলুল্লাহ - সা : - ) জিজ্ঞেস করল : হে রাসূলুল্লাহ , আপনি কি এ দুজনকে ( হাসান ও হুসাইন ) ভালবাসেন ? তখন তিনি ( রাসূলুল্লাহ - সা: -) বললেন : যে এ দুজনকে ( হাসান ও হুসাইন ) ভালবাসে সে আমাকেই ভালবাসে এবং যে এ দুজনকে ঘৃণা করে সে আমাকেই ঘৃণা করে । ( আল হাকিম বলেন : ) এ হাদীসটি সহীহুল ইসনাদ এবং বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি । আর আত তালখীস গ্রন্থে আল্লামাহ যাহাবীও ( আল হাকিমের সাথে ) একমত পোষণ করে বলেছেন : ( এই হাদীসটি ) সহীহ ।
عن أبي هريرة - رض - قال له رجل : يا رسول الله إنک تحبُّهما ؟ فقال : نعمت ، من أحبّهما فقد أحبّني ، و من أبغضهما فقد أبغضني .
দ্র : আল মুস্তাদ্রাক আলাস সহীহাইন , খ : ৩ , পৃ : ৩৭৬ , হাদীস নং ৪৮৩৮ ।
আদী ইবনে সাবিত বলেন : আমি বারা ইবনে আযেব কে বলতে শুনেছি : আমি মহানবীকে ( সা:) দেখলাম যে তিনি হাসান ইবনে আলীকে কাঁধে বসিয়ে বলছেন : হে
আল্লাহ , নিশ্চয়ই আমি একে ভালোবাসি অতএব আপনিও তাকে ভালোবাসুন । আবূ ঈসা বলেন : এটা হাসান সহীহ হাদীস । আর এ হাদীসটি ফুযাইল ইবনে মারযূকের হাদীস থেকে অধিক সহীহ । ( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৩১ : হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস সালামের মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৯২ , পৃ : ৯৯১ )
ইবনে আব্বাস বলেন : রাসূলুল্লাহ ( সা :) বলেছেন : মহান আল্লাহর যে সব নেয়ামত তোমাদের কাছে আগমন করে সেগুলোর জন্য তাঁকে ( মহান আল্লাহ ) ভালোবাসো তোমরা , মহান আল্লাহকে ভালবাসার কারণে তোমরা আমাকে ভালোবাসো এবং আমার ভালোবাসার জন্য আমার আহলুল বাইতকে ( আ :) তোমরা ভালবাসো । আবূ ঈসা বলেন : এটা হাসান গরীব হাদীস ..... । ( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৩২ : মহানবীর ( সা:) আহলুল বাইতের ( আ:) মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৯৮, পৃ : ৯৯২ )
হযরত আলী ( আ:) বলেন : রাসূলুল্লাহ ( সা:) হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বললেন : যে ব্যক্তি আমাকে , এ দুজনকে এবং এদের পিতা মাতাকে ভালোবাসে সে কিয়ামত দিবসে আমার সাথে আমার পর্যায়ে থাকবে ( অবস্থান করবে ) । আবূ ঈসা বলেন : এটি হাসান গরীব হাদীস .... ।
( দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ২১ : হযরত আলী ইবনে আবী তালিবের ( রা:) মানাক্বিব , হাদীস নং ৩৭৪২ , ৯৮২ )
হযরত আবূ হুরায়রা ( রা:) থেকে । তিনি ( আবূ হুরায়রা ) বলেন : আলী , হাসান , হুসাইন ও ফাতিমার ( আ:) দিকে তাকিয়ে বলেছেন : যে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ে ( যুদ্ধ কর ) তার বিরুদ্ধে আমিও লড়ি ( যুদ্ধ করি ) এবং তোমাদের সাথে যে সন্ধি ( ও শান্তি স্থাপন করে ) আমিও তার সাথে সন্ধি ( ও শান্তি স্থাপন করি ) ।
نظر رسول اللّٰه ( ص) إلی عليّ و الحسن و الحسن و فاطمة فقال : أنا حرب امن حاربکم و سلم لمن سالمکم .
(( দ্র : ইবনুল আসীর আল জাযারী প্রণীত আল - বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ , খ: ৮ , পৃ : ২২০৯ , প্রকাশক : দার সাদির , বৈরুত , লেবানন , প্রথম সংস্করণ , ২০০৫ খ্রী: ( ১৪২৬ হি. ) ))
হযরত যাইদ ইবনে আরকাম বলেন যে রাসূলুল্লাহ (সা:) আলী , ফাতিমা , হাসান ও হুসাইন কে বললেন : তোমারা যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর আমিও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি এবং তোমরা যা র সাথে সন্ধি ( ও শান্তি স্থাপন ) কর আমিও তার সাথে সন্ধি ( ও শান্তি স্থাপন) করি ।
عن زید بن أرقم أنّ رسول الله -ص- قالب ل علي و فاطمة و الحسن و الحسين : أنا حزب لمن حاربتم و سلم لمن سالمتم .
দ্র : প্রাগুক্ত সহীহ সুনান আত তিরমিযী , কিতাবুল মানাক্বিব , অনুচ্ছদ ৬১ : ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ - সাল্লাল্লাহু আলাইহিমা ওয়া সাল্লাম - এর ফযীলত , হাদীস নং ৩৮৭৯ , পৃ : ১০০৭ )
অপর দিকে , অন্য সকল সাহাবা এমনকি অখ্যাত হলেও খুব সহজে ও অনায়াসে তাদের ফাযায়েল বর্ণনা করা যেত এবং রাবীদেরকে ও মুহাদ্দিস গণকে প্রথম তিন খলীফা , মুহাজির , আনসার , আরবের বিভিন্ন গোত্র (যেমন : আশ'আরী গোত্র ও এ গোত্রের আবূ মূসা আশ'আরী ) , যারা আহলুল বাইতের ( আ:) হযরত আলী ( আ:) , হযরত ফাতিমা ( আ:) , ইমাম হাসান ( আ:) ও ইমাম হুসাইনের ( আ:) বিরোধী ছিল যেমন: বনী উমাইয়া এবং বিশেষ করে আবূ সুফিয়ান , মুআবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ান , তাঁর মা হিন্দা , মারওয়ান , তালহা , যুবাইর , আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর , হযরত আয়েশা , হযরত হাফসা তাদের ও বিভিন্ন সাহাবার ফযীলতের হাদীস বর্ণনা করতেই খিলাফত ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশি বেশি উৎসাহ প্রদান করা হত ।
একটা বিষয় যা বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন তা হচ্ছে হাদীস লিখন , পঠন , সংকলন ও বর্ণনা নিষিদ্ধ করন প্রসঙ্গ । প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকরের ( রা:) সময় হাদীস সংকলন , লিপিবদ্ধ করেন ( লিখন ) , পঠন ও বর্ণনা নিষিদ্ধ করা হয় এ যুক্তিতে যে হাদীস চর্চা করা হলে তা পবিত্র কুরআনের সাথে মানুষ মিলিয়ে ও গুলিয়ে ফেলবে এবং তাতে পবিত্র কুরআনে বিকৃতি দেখা দিবে !!!! হাদীস চর্চা ও বর্ণনা করলে নাকি নিজেদের অনেক কথা রাসূলুল্লাহর ( সা:) বাণী ও হাদীস বলে চালিয়ে দেবে বা রাসূলের বাণীর সাথে মিশিয়ে ফেলবে !!! হযরত আবূ বকর ( রা:) খলীফা হওয়ার পর তার নিজ সংকলিত মহানবীর ( সা :)৫০০ হাদীস পুড়িয়ে দেন এ সন্দেহে যে সেগুলোয় হয়তো এমন কিছু কথা থাকতে পারে যা রাসূলুল্লাহর ( সা: ) বাণী ( হাদীস ) নয় । নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে তিনি এ হাদীসগুলো পুড়িয়ে ফেলেন ।
হযরত উমর ( রা:) এ নিষেধাজ্ঞা খুব কঠোর ভাবে পালন করতেন । তিনি হাদীস বর্ণনা কারীকে প্রহার করেছেন ও আটকে ( বন্দী করে ) রেখেছেন । এমনকি তিনি জনগণ সংকলিত হাদীস সমূহ দেখতে চাইলে তারা তাঁর কাছে ঐ সব সংকলিত হাদীস উপস্থিত করে এ আশায় যে তিনি সেগুলো দেখে যে সব হাদীস নির্ভরযোগ্য সেগুলো চিহ্নিত করবেন ; কিন্তু সবার প্রত্যাশার বাইরে খলীফা উমর হাদীস সমূহের সংকলন গুলো পুড়িয়ে ফেলেন এ যুক্তিতে যে ঠিক যেমন আসলে কিতাব কিতাবুল্লাহ বাদ দিয়ে শুধু রিওয়ায়ত চর্চা করত ঠিক তেমনি মুসলিম জনসাধারণও পবিত্র কুরআন বাদ দিয়ে শুধু হাদীস বর্ণনা ও চর্চায় মত্ত হয়ে যাবে । খলীফা উমর হাদীস বর্ণনা করার জন্য হযরত আবূ হুরায়রা কে প্রহার করেছিলেন । তাযকিরাতুল হুফ্ফাযে আল্লামাহ যাহাবী উল্লেখ করেছেন যে হযরত উমর ইবনে মাসউদ , আবুদ্দারদা ও আবূ মাসউদ আনসারীকে অন্তরীন করে বলেছিলেন : আপনারা রাসূলুল্লাহ ( সা:) অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন । আবূ ইয়া'লা আল - খলীলীর কিতাবুল ইরশাদে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত উমর কতিপয় ব্যক্তিকে আটক করেছিলেন যাদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রাও ছিলেন । তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন : আপনারা রাসূলুল্লাহ ( সা: ) থেকে হাদীস কম বর্ণনা ( রিওয়ায়ত ) করবেন । আর ঐ ব্যক্তি গণ হযরত উমরের মৃত্যু পর্যন্ত অন্তরীন ছিলেন । খলীফা হযরত উসমানের ( রা:) খিলাফত কালেও হাদীস চর্চা , সংকলন , লিখনের নিষেধাজ্ঞা বহাল ও বলবত ছিল এবং হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি ও অব্যাহত ছিল । উল্লেখ্য যে বহু বড় বড় প্রবীণ সাহাবা হাদীস বর্ণনা ও চর্চা ত্যাগ করেছিলেন । বুখারী সায়েব ইবনে যাইদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি অনেক প্রবীন সাহাবার সাহচর্যে ছিলেন এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহর ( সা:) হাদীস বর্ণনা ও রিওয়ায়ত করতে শুনেন নি । তবে তিনি হযরত তালহাকে ( রা:) কেবল উহুদের যুদ্ধের দিন সম্পর্কে বর্ণনা করতে শুনেছেন !!! আযওয়াউন আলাস সুন্নাতিল মুহাম্মাদীয়াহ গ্রন্থে শেখ মাহমূদ আবূ রাইয়া বলেন : " খুলাফা - ই রাশিদীন , প্রবীণ সাহাবা গণ এবং সাহাবাদের মধ্যে যারা ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতা ছিল তারা মহানবীর ( সা:) বর্ণনা করতে ভয় করতেন বরং তারা হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতেন না । " আবার অনেক প্রবীণ সাহাবা রাসূলুল্লাহর হাদীসে হ্রাস বৃদ্ধির আশঙ্কায় হাদীস রিওয়ায়ত করতেন না । ( তবে রাসূলুল্লাহর আহলুল বাইত যেমন : হযরত আলী (আ:) সবসময় হাদীস চর্চার পক্ষে ছিলেন । )…চলবে…