۲۹ شهریور ۱۴۰۳ |۱۵ ربیع‌الاول ۱۴۴۶ | Sep 19, 2024
কুরআনের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নাবী (ছা.) ও জন্মদিন উদযাপন
ঈদে মীলাাদুন্নাবী (ছা.)

‘হাওজা / ঈদে মীলাাদুন্নাবী (ছা.) নামে উৎসব উদযাপন করা জায়েয কি না – এ ব্যাপারে বিশেষ আলোচনা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ব্যক্তিদের জন্মদিন পালন, বিশেষ করে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ‘ঈদে মীলাাদুন্নাবী (ছা.) নামে উৎসব উদযাপন করা জায়েয কি না – এ ব্যাপারে বিগত কয়েক দশক যাবত আমাদের দেশে বিতর্ক চলে আসছে। ইন্টারনেটে এক আলোচনায় জনৈক আলেমকে এ কাজকে সুস্পষ্ট ভাষায় নাজায়েয, বিদ‘আত্ ও গুনাহর কাজ বলে অভিহিত করতে শুনলাম; মৃত্যুদিবস পালন সম্পর্কেও তাঁর একই মত। সংশ্লিষ্ট আলেম একজন জনপ্রিয় আলোচক এবং তিনি তাঁর মতের সপক্ষে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করছি।

আলোচনার সংক্ষেপণের জন্য শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনে ও শারী‘আতে “অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে” যা কিছু হারাম ও নাজায়েয জন্মদিন ও মৃত্যুদিবস পালন সহ যে কোনো অনুষ্ঠানে সে ধরনের কাজ আঞ্জাম দেয়া গুনাহর কাজ হওয়ার ব্যাপারে বিতর্কের কোনোই অবকাশ নেই। সুতরাং আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে এ ধরনের কোনো উপলক্ষ্যে মোবাহ্ ও উত্তম কাজ আঞ্জাম দেয়া জায়েয কি না! এ ক্ষেত্রে আমাদের মত এই যে, মোবাহ্ ও উত্তম কাজ কোনো অবস্থায়ই নাজায়েয হতে পারে না, তা সে কাজ যে উপলক্ষ্যেই আঞ্জাম দেয়া হোক না কেন।

দ্বিতীয়ত: বিদ্‘আতের সংজ্ঞা অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে হতে হবে। ইসলামে কোনো বিধিবদ্ধ ‘ইবাদতের কাজ হিসেবে এমন কোনো কাজের প্রচলন করা– যা দ্বীনের অকাট্য জ্ঞানসূত্রসমূহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা বিদ্‘আত্ হওয়ার ব্যাপারে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যারা মনে করেন যে, রাসূলুল্লাহর (ছা.) যুগে আঞ্জাম দেয়া হতো না দ্বীনের জন্য এমন যে কোনো উত্তম কাজ আঞ্জাম দেয়া বিদ্‘আত্ এবং তাতে ছাওয়াব হবে না, বরং গুনাহ্ হবে, তাঁদের সাথে আমরা একমত নই। কারণ, এ ধরনের অনেক কাজ ইসলামের সকল ধারার অতীতের সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষীগণ আঞ্জাম দিয়েছেন এবং পরিহাসের বিষয় এই যে, উক্ত আপত্তিকারী আলেমগণ নিজেরাও এ ধরনের অনেক কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহর (ছা.) যুগের অনেক পরবর্তীকালে হাদীছ সংকলন করা হয়, ইজতিহাদ করা হয়, ফিক্বহী গ্রন্থ ও দ্বীনী জ্ঞনগবেষণামূলক গ্রন্থাবলী রচনা করা হয়, তাফসীর লেখা হয়, ওয়াজ মাহফিল ও তাফসীর মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে, ইসলামী সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে। রাসূলুল্লাহর (ছা.) যুগে প্রাতিষ্ঠানিক দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র (মাদ্রাসাহ্) ও দ্বীনী জ্ঞানগবেষণাকেন্দ্র ছিলো না, এখন আছে। দ্বীনী মাদ্রাসায় শিক্ষাগ্রহণকারীদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ দেয়া হচ্ছে এবং অথবা দাস্তারবান্দী অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।

এক সময় মাইকে আযান দেয়াকে নাজায়েয গণ্য করা হতো; এখন তা সকলেই মেনে নিয়েছেন। রেডিও-টেলিভিশন, অডিও-ভিডিও ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও ইসলাম বিষয়ক মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে। সুতরাং দ্বীনের জন্য যে কোনো মোবাহ্ ও উত্তম কাজ আঞ্জাম দেয়া যেতে পারে। (এমনকি, কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক জনসভা পর্যন্ত শুরু করা হচ্ছে, যদিও এ ধরনের সভায় অনেক সময় মিথ্যাচার, গীবত ও সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ প্রচার করা হচ্ছে, অথচ এতে কোরআন তেলাওয়াতকে কেউ নাজায়েয ফতওয়া দিচ্ছেন না, যদিও অত্র নিবন্ধকারের মতে, মূলগতভাবেই গীবত, মিথ্যাচার ও সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ প্রচারের জন্য সভার আয়োজনই জায়েয নয়।)

জন্মদিন ও মৃত্যুদিবস পালন এবং ‘ঈদে মিলাদুন্নাবী (ছা.) উদযাপন নাজায়েয গণ্যকারী উক্ত আলেম যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, যেহেতু ছাহাবীগণ ‘ঈদে মিলাদুন্নাবী (ছা.) উদযাপন করেন নি সেহেতু তা উদযাপন করা বিদ্‘আত্ এবং তিনি বলেছেন যে, যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ (ছা.) সোমবার জন্মগ্রহণ করেন সেহেতু তিনি প্রতি সোমবার নফল রোযা রাখতেন, সুতরাং যারা রাসূলুল্লাহর (ছা.) জন্মদিন পালন করতে চান তাঁরা এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক সোমবার রোযা রাখতে পারেন।

ছাহাবীদের যুগে ছিলো না দ্বীনী উদ্দেশ্যে এমন মোবাহ্ ও উত্তম কাজ যে করা যাবে তার দৃষ্টান্ত আমরা উপরে তুলে ধরেছি। দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে বলতে চাই যে, রাসূলুল্লাহ্ (ছা.) নিয়মিত প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন এটা কোনো অকাট্য প্রমাণিত তথ্য নয়; খাবারে ওয়াাহেদ হাদীছ ভিত্তিক এ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণে টিকে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (ছা.) যদি প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন তাহলে ছাহাবীদের অনেকেই, অন্তত একটি বিরাট সংখ্যক ছাহাবী এ কাজ করতেন। ফলে ইসলামে এটি প্রায় ফরয/ ওয়াাজিব-এর ন্যায় প্রচলিত হয়ে যেতো। তাছাড়া স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (ছা.) যদি নিয়মিত প্রতি সোমবার রোযা রাখার মাধ্যমে তাঁর জন্মদিন পালন করতেন তাহলে ছাহাবীগণ একই নিয়মে তার জন্মদিন পালন করতেন না– এটা হতেই পারে না। স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (ছা.) যুগে তারাবীহ্ নামাযের প্রচলন না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে পরে তা চালু হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতি সোমবারে রোযা রাখলে অবশ্যই তা তাঁর যুগ থেকেই প্রায় সর্বজনীনভাবে প্রচলিত হয়ে যেতো।

উক্ত আলোচক আলেম আরো বলেছেন যে, জন্মদিন ও মৃত্যুদিবস পালন করলে ছাওয়াব হবে না, বরং গুনাহ্ হবে, কেবল তা-ই নয়, বরং এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিদেহী নাফসে ছাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ছাওয়াব রেসানী করলে মৃত ব্যক্তির জন্য তা শান্তির কারণ না হয়ে তার জন্য আযাবের কারণ হবে। [অবশ্য এটা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ছা.) সম্পর্কে বলেননি।]

আমরা আগেই বলেছি যে, আমরা জন্মদিবস উদযাপন ও মৃত্যুদিবস পালনকে কেবল এ শর্তে জায়েয গণ্য করি যে, তাতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো হারাম ও নাজায়েয কাজ আঞ্জাম দেয়া হবে না। এমতাবস্থায় এ ধরনের অনুষ্ঠানে যদি কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, দো‘আ ও মুনাজাত করা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভালো কাজগুলো স্মরণ করে তা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা হয় এবং এ উপলক্ষ্যে দান-ছাদাক্বাহ্ করা হয় তাহলে তাতে মৃত ব্যক্তির নাফসে ছাওয়াবের পরিবর্তে আযাব পৌঁছবে– এরূপ দাবীর সপক্ষে অবশ্যই ইসলামের কোনো না কোনো অকাট্য জ্ঞানসূত্র (সর্বজনীন সুস্থ ‘আক্বল বা কোরআন মজীদ বা মুতাওয়াতির হাদীছ বা উম্মাহর মতৈক্য) থেকে দলীল থাকতে হবে। কারণ, কোরআন তেলাওয়াত, দো‘আ, মুনাজাত, নফল নামায, নফল রোযা ও সাধারণ দান-ছাদাক্বাহ্ এমন ধরনের ঐচ্ছিক ‘ইবাদত দ্বীন ও শারী‘আতে যার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বা পরিমাণ নির্ধারণ করা নেই যে, তার অগ্র-পশ্চাত বা কম-বেশী হলে তা বিদ‘আত্ ও গুনাহর কাজ হবে; আর যুক্তির খাতিরে যদি তা মেনেও নেয়া হয় তো সে জন্য সে কাজ আঞ্জামদানকারীদের গুনাহ্ হতে পারে; মৃত ব্যক্তির নাফসের আযাব হবে– এমন দাবীর সপক্ষে অবশ্যই অকাট্য দলীল থাকতে হবে। নচেৎ দ্বীন ও শারী‘আতের ব্যাপারে এ ধরনের মনগড়া ফতওয়া দেয়ার অধিকার কারোরই নেই, বরং নিঃসন্দেহে এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :
وَلا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولا
“যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ের ওপর থেমে যেয়ো না (‘আমল করো না বা মতামত ব্যক্ত করো্ না); নিঃসন্দেহে শ্রবণশক্তি, দর্শনশক্তি ও অন্তঃকরণ– এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”
(সূরাহ্ বানী ইসরাাঈল্ / আল্-ইসরাা’ : ৩৬)

ইসলামের অকাট্য বিষয়সমূহের অন্যতম এই যে, যা ফরয/ ওয়াাজিব্ বা হারাম নয় এমন যে কোনো কাজই মোবাহ্ (আপত্তিহীন) বা বৈধ (জায়েয)। অবশ্য মোবাহ্ কাজের মধ্যে কতক কাজ পছন্দনীয় (মুস্তাহাব), কতক কাজ অছসন্দনীয় (মাকরূহ্) ও কতক কাজ এতদুভয়ের কোনোটাই নয়; স্রেফ মোবাহ। এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, জন্মদিন ও মৃত্যুদিবস পালন, বিশেষ করে ‘ঈদে মীলাদুন্নাবী (ছা.) উদযাপন ফরয/ ওয়াজিবও নয় (আর কেউ ফরয/ ওয়াাজিব বলে গণ্যও করে না), হারামও নয়। বরং এটি একটি উত্তম ও শিক্ষণীয় সংস্কৃতি।

এবার আমরা দেখবো এ বিষয়ে কোরআন মজীদ থেকে কোনো আলো পাওয়া যায় কি না।
কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে নবী-রাসূলগণের (‘আ.) জন্ম আনন্দের বিষয়। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা বেশ কয়েক জন নবী-রাসূলের (আ.) জন্মের আগাম সংবাদ দিতে গিয়ে তাকে “সুসংবাদ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
হযরত ইবরাহীম (‘আ.) একজন সুসন্তানের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আবেদন জানালে আল্লাহ্ তা‘আলা তা কবূল করেন এবং হযরত ইসমা‘ঈল (আ.)-এর জন্মের আগাম সুসংবাদ দেন; এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে :
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلامٍ حَلِيمٍ
“অতঃপর আমি তাকে একজন ভদ্র-নম্র পুত্রের (জন্মের) আগাম সুসংবাদ দিলাম।” (সূরাহ্ আছ-ছাফফাত্ : ১০১)

তেমনি হযরত ইসহাক্ব্ (আ)-এর জন্মের আগাম সুসংবাদ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে:
وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ
“আমি তাকে (ইবরাহীমকে) ইসহাক্বের (জন্মের) আগাম সুসংবাদ দিলাম– যে সুযোগ্য নবীদের অন্যতম।” (সূরাহ্ আছ-ছাফফাত্: ১১২)

আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত যাকারীয়া’ (‘আ.)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন:
يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلامٍ اسْمُهُ يَحْيَى لَمْ نَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا
“হে যাকারিয়া! নিঃসন্দেহে তোমাকে একটি পুত্রের (জন্মের) আগাম সুসংবাদ দিচ্ছি– যার নাম ইয়াহইয়া; তার জন্য এমন কোনো নামকরণ করিনি পূর্বে কেউ যে নামের অধিকারী ছিলো।” (সূরাহ্ মারইয়াম: ৭)
আল্লাহ্ তা‘আলা চাইলে এ সব আয়াতে যথাক্রমে اَخبَرنا (সংবাদ দিলাম) ও نُخبِرُ (সংবাদ দিচ্ছি) বলতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা বলেননি, বরং সুসংবাদের কথা বলেছেন।

শুধু তা-ই নয়, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইয়াহইয়া (আ.)কে তাঁর জন্মের পর অভিনন্দন (সালাম) জানান। এরশাদ হয়েছে :
وَسَلامٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا
“অভিনন্দন (সালাম) তার প্রতি যেদিন সে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যেদিন সে মৃত্যুবরণ করবে ও যেদিন সে জীবিত অবস্থায় উত্থিত হবে।” (সূরাহ্ মারইয়াম: ১৫)
আর হযরত ‘ঈসা (আ.) তাঁর মাতৃক্রোড়ে থাকা অবস্থায় বানী ইসরাঈলের লোকদের উদ্দেশে স্বীয় নবুওয়াতের ঘোষণা প্রদানের পর নিজেকেই নিজে অভিনন্দিত করেন; তিনি বলেন :
وَالسَّلامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
“অভিনন্দন (সালাম) আমার প্রতি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করবো ও যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় উত্থিত হবো।” (সূরাহ্ মারইয়াম: ৩৩)

উপরের আয়াতগুলোতে “সালাম” অর্থ “শান্তি বর্ষিত হোক” করা সম্ভব নয়। কারণ, প্রতিটি আয়াতেই জন্মের পরে সালামের কথা আছে, আর “শান্তি বর্ষিত হোক” কথাটা ভবিষ্যত কাল বাচক; অতীতে যা ঘটেছে সে জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। আর যেহেতু আয়াতগুলোতে সুস্পষ্টভাবে কোনো ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়নি সেহেতু তাতে অতীতে জানানো অভিনন্দন এবং ভবিষ্যতের জন্য আগাম অভিনন্দন উভয় অর্থকেই শামিল করা সম্ভব।
অতএব, এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, নবী-রাসূলগণের (‘আ.) জন্ম আনন্দের ঘটনা বা সুসংবাদ এবং সে জন্য তাঁরা তাঁদের “জন্মের দিনে” অভিনন্দন পাওয়ার উপযুক্ত। শুধু তা-ই নয়, যেহেতু তাঁদের পার্থিব মৃত্যু মানে অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালনের পর প্রভুর সান্নিধানে উপস্থিতি- যখন আর তাঁরা দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হবার আশঙ্কা করছেন না সেহেতু পার্থিব মৃত্যু তাঁদের জন্য আনন্দের ব্যাপার, সুতরাং তা-ও অভিনন্দনযোগ্য।

[স্মর্তব্য নবী-রাসূলগণের (আ.) ও আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত ইমামগণের (‘আ.) ‘ইছমাত্ (গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ততা)-এর মানে তাঁদের গুনাহ্ ও ভুল করার ক্ষমতা না থাকা নয়, বরং রক্তধারার পবিত্রতা ও ভালো-মন্দ কাজের পরিণাম সম্পর্কে ‘ইলমে হুযূরীর অধিকারী হবার কারণে তাঁরা স্বেচ্ছায় গুনাহ্ হতে মুক্ত থাকেন, সেহেতু গুনাহর ও দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য করার ক্ষমতা থাকার কারণে তাঁরা সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতেন।]

আর এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, নিষ্পাপ অবস্থায় জন্মগ্রহণের কারণে যে কোনো শিশুর জন্মই সুসংবাদ ও অভিনন্দনযোগ্য এবং দৃশ্যতঃ আমরা যাদেরকে নেককার হিসেবে জানি তাঁদের জন্মদিনও আমাদের জন্য আনন্দের। তাই এ উপলক্ষ্যে নির্দোষ আনন্দ-উৎসব করায় গুনাহ্ হওয়ার কোনোই কারণ নেই। বিশেষ করে নিষ্পাপ বা নেককার ব্যক্তিদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা উৎসবে (ও মৃত্যুদিবসের অনুষ্ঠানেও) যদি কোরআন তেলাওয়াত, দো‘আ, মুনাজাত ইত্যাদি ছাওয়াবের কাজ আঞ্জাম দেয়া হয় ও দান-ছাদাক্বাহ্ করা হয় এবং তাঁদের জীবনাচরণ ও আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করে উত্তম শিক্ষা গ্রহণ করা হয় তাহলে তা খুবই উত্তম।

উক্ত আলোচক আরেকটি কথা বলেছিলেন যে, পিতা-মাতার জন্য কোরআন মজীদে যে দো‘আ শিক্ষা দেয়া হয়েছে (রাব্বিরহাম্ হুমা কামাা রাব্বাইয়ানী ছাগ্বীরাা) নামাযের পরে নিয়মিত তা পাঠ করলেই যথেষ্ট; পিতা-মাতার জন্মদিনে বা মৃত্যুদিবসে অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই; করলে তাঁদের নাফসের আযাব হবে।

বিদেহী নাফসের আযাব হওয়া সম্পর্কিত তাঁর এ ফতওয়ার জবাব আমরা ইতিপূর্বেই দিয়েছি। অর্থাৎ এ জন্য অকাট্য দলীল অপরিহার্য– যা নেই। এখানে কেবল এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা উপরোক্ত দো‘আ শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে অন্য কোনো ধরনের দো‘আ করতে বা আলাদা ছাওয়াবমূলক অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেননি। আল্লাহ্ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্তে সতর রাক‘আত্ নামায ফরয/ ওয়াজিব করেছেন, আবার জুমু‘আহকে সাপ্তাহিক নামায হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, তেমনি দুই ঈদের সময় ‘ঈদের নামায আদায়ের বিধান দেয়া হয়েছে। আর জুমু‘আহ্ ও ঈদের নামাযে যে খুত্ববাহ্ দেয়ার বিধান দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য নামাযীদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনী দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দান করা ও সচেতন করা। এর পরও যার পক্ষে সম্ভব সে যতো বেশী নফল নামায আদায় করতে পারে এবং লোকদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্যের শিক্ষা দিতে পারে। সুতরাং কোনো ঐচ্ছিক ভালো কাজকেই সীমিত করার ফতওয়া দেয়ার অধিকার কারো থাকতে পারে না, যদি না কেউ এ ধরনের কাজকে দ্বীনের বিধিবদ্ধ ইবাদত বলে গণ্য করে বা কারো আল্লাহর দুশমন তথা দ্বীনের দুশমন হওয়া সম্পর্কে অকাট্য ধারণা রাখা সত্ত্বেও তার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠান করে, নচেৎ যে কোনো সাধারণ গুনাহগার ব্যক্তির জন্যও ছাওয়াব ও দো‘আর অনুষ্ঠান করা নাজায়েয হতে পারে না, কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার সীমিতসংখ্যক মা‘ছূম বান্দাহ্ (‘আ.) ব্যতীত আমরা কেউই গুনাহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত নই এবং আমাদের পিতা-মাতাগণও গুনাহ্ থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন না। বরং আমাদের সকলের জন্য ও আমাদের প্রিয় মৃত ব্যক্তিদের জন্যও দো‘আ ও দান-ছাদাক্বাহর এবং ছাওয়াব রেসানীর প্রয়োজন রয়েছে।

তাছাড়া স্বাভাবিক মানবিক দুর্বলতার কারণে আমরা অনেক সময় প্রিয়জনদের জন্য নিয়মিত দো‘আ করতে ভুলে যাই; জন্মদিনে বা মৃত্যুদিবসে তাঁদের কথা বেশী বেশী স্মরণ হয় (ঠিক যেভাবে কোনো চেনাজানা মৃত ব্যক্তির কথা আমাদের সব সময় মনে না পড়লেও তার কবরের পাশ দিয়ে গেলে আমাদের তার কথা মনে হয় ও আমরা তার জন্য দো‘আ করি) এবং এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে যেমন দো‘আ ও ছাওয়াবের অনেক বেশী কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হয়, তেমনি অনেক লোক একত্রিত হয়ে দো‘আ করা হয় বিধায় আশা করা যায় যে, একা একা দো‘আ করার পাশাপাশি এ ধরনের অনুষ্ঠন করা হলে তাতে হয়তো এমন কোনো বা কোনো কোনো লোক উপস্থিত থাকতে পারেন যার বা যাদের দো‘আ কবূল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম (ছা.)-এর জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর জীবন, কর্ম ও শিক্ষার ওপর যে সব শিক্ষামূলক আলোচনা হয় তা শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেরই পূর্বে জানা থাকে না, বা জানা থাকলেও তা স্মরণে থাকে না। তাই ঈদে মীলাদুন্নাবী (ছা.)-এর অনুষ্ঠনের ও রাসূলুল্লাহর (ছা.) ওফাত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানের এবং অন্যান্য মা‘ছূম ব্যক্তিদের (‘আ.) ও উত্তম লোকদের জন্ম-মৃত্যু উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানের কল্যাণকারিতা কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

লিখেছেন ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক জনাব নূর হোসাইন মাজিদী

تبصرہ ارسال

You are replying to: .