হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার জেরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজাতে পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। এরপর থেকে টানা ১১ মাস ধরে ভূখণ্ডটিতে একের পর এক হামলা ও অভিযান চালায় ইহুদীবাদী দখলদার দেশটির সামরিক বাহিনী।
গাজায় হামলার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে ইসরায়েলের সাথে। সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েই চলছিল এই দুই দেশের হামলা ও পাল্টা হামলা। অবশেষে গত সপ্তাহ থেকে গাজার পাশাপাশি লেবাননেও পুরোদমে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।
টানা ১১ মাস ধরে চলমান যুদ্ধে ভাঙনের মুখে ইসরায়েলের অর্থনীতি। বিশেষ করে যুদ্ধ সম্প্রসারিত এবং ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে গুরুতর বিপদে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। বেড়েছে ঋণ, বিপরীতে তেমন বাড়েনি আয়। গত এক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক হাজার ব্যবসা। হারাতে হয়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিগগিরই যুদ্ধ না থামালে সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতি দাঁড়াবে।
মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
গত বছর অক্টোবরে উত্তর ইসরায়েলে শেলি লোটানের খাদ্যবিষয়ক স্টার্টআপ কোম্পানির যাত্রা যখন শুরু হয় তখনই সীমান্ত জুড়ে হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে এবং দেশটির সরকার এ অঞ্চলের সবাইকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল সরকার শেলি লোটানের দোকানের পাঁচজন কর্মচারীর মধ্যে দুজনকে সেনাবাহিনীতে ডেকে নেন। যাদেরকে ডাকা হয়নি, তারা আরেক কর্মচারীর বাবা-মায়ের বাসার ভূগর্ভস্থ কক্ষে সেই স্টার্টআপের কার্যালয় সরিয়ে নেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তার ব্যবসায় বিনিয়োগের গতি নেই বললেই চলে।
হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের এক বছর পূর্ণের সময় ঘনিয়ে আসলেও যুদ্ধ বিরতির লক্ষণ নেই বললেই চলে। উল্টো লেবাননে হিজবুল্লাহ বাহিনীর ওপর পুরোদমে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এই পরিস্থিতিতে লোটানের ব্যবসা কোনোভাবে টিকে আছে। সরকারের ওপর ক্ষোভ বাড়ছে লোটানের। সেই সঙ্গে বাড়ছে অর্থনৈতিক চাপও।
ইসরায়েলের অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে খুব একটা আলোচনা না হলেও গত এক বছরের মধ্যে ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বড় ধরণের প্রভাব পড়েছে। দেশটির ঋণমান অবনমন হয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকুচিত হয়েছে এবং হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া অনেক মানুষের চাকরি গেছে; কোম্পানিগুলো দূরবর্তী জায়গা থেকে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ সেনা হিসেবে যাঁরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা সৈনিক জীবনের সঙ্গে মূল ক্যারিয়ারের ভারসাম্য আনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ২ লাখ ৮৭ হাজার নাগরিক রিজার্ভ সেনা হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। ইসরায়েলের জনসংখ্যা এক কোটির কম। অর্থাৎ দেশটির এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি কীভাবে চলছে, তা বড় প্রশ্ন।
ইসরায়েলের অর্থনীতির বিশেষ দিক হলো তার বিশাল উচ্চ প্রযুক্তি খাত। এই খাতে যুদ্ধের তেমন প্রভাব না পড়লেও বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে নির্মাণ ও কৃষি খাতে। এই দুটি খাত আবার ইসরায়েলে কাজ করতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের কাজের অনুমতি বাতিল করায় বেশ ভালো ধরণের প্রভাব পড়েছে এই দুই খাতে।
যুদ্ধের কারণে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা ইসরায়েলের পর্যটন খাতের। যুদ্ধের পর থেকে দেশটিতে এই খাতের ব্যবসা কমেছে ৭৫ শতাংশের বেশি। অন্যান্য সময়ে জেরুজালেমের পুরোনো শহর পর্যটকে ভরা থাকলেও বর্তমানে এই এলাকার বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে যুদ্ধকে ঘিরে বেড়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়। গত এক বছরে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়ে অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে। লেবাননে হামলার আগেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক বার্তা ছিল যে, ২০২৫ সালের মধ্যে ইসরায়েলের যুদ্ধজনিত ক্ষতি ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। তবে লেবাননে ইসরায়েলের চলমান হামলার ফলে বাস্তব ক্ষতি এর চেয়ে অনেক বেশি হবে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ইসরায়েলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান শোরেশ ইনস্টিটিউশন ফর সোশিওইকোনমিক রিসার্চের প্রধান ড্যান বেন ডেভিড ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ইসরায়েলের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপদে আছে; সরকারকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন সরকারের সব মনোযোগ যুদ্ধ নিয়ে। এর অবসানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগ কম, জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি, অনিশ্চয়তা সব কিছুর মধ্যে অনেকেই গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসা, আবার অনেকে ব্যবসা শুরু করতেই ভরসা পাচ্ছেন না।
এমনিতে ইসরায়েলের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও যুদ্ধের পর থেকে বদলে গেছে পরিস্থিতি। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের শেষ দেখা যাচ্ছে না। এখন তার ওপর হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ইসরায়েলের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দেশটির নাগরিকেরা শঙ্কিত। তাঁদের ভাষ্য, দুটি যুদ্ধের ভার এই অর্থনীতি নিতে পারবে না।