হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মাসুম আলী গাজী নাজাফী
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا شَهْرَ اَلله اَلْأَكْبَرَ وَ يَا عِيدَ أَوْلِيَائِهِ
এই বছরের পবিত্র রমজান মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকার এবং এই বরকতময় মাসে তাঁর মেহমান হওয়ার তৌফিক প্রদানের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার যতই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হোক না কেন তা যথেষ্ট নয়।
যে মাসটি এবাদত-বন্দেগীর সূচনা, যে মাসটির জন্য আল্লাহর সাধকগণ সারা বছর অপেক্ষা করেন, সেই মাসটি এখন আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। রহমত, বরকত, মাগফেরাত, অনুতপ্ত ও অনুশোচনার মাস বিদায় নিতে চলেছে। আমরা আর মাত্র কয়েক দিনের অতিথি।
ওই মাস আমাদের থেকে বিদায় নিতে চলেছে, যার জন্য মহানবী (সাঃ) বলেন :
يُنْزِلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مَلاَئِكَتَهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ يَقُولُ اَللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ
هَلْ مِنْ سَائِلٍ فَأُعْطِيَهُ سُؤْلَهُ-
هَلْ مِنْ تَائِبٍ فَأَتُوبَ عَلَيْهِ-
هَلْ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ
পরাক্রমশালী ও মহিমান্বিত আল্লাহ তাআলা পবিত্র রমজান মাসের প্রতি রাতে তিনবার করে ফেরেশতা পাঠান এবং তাঁরা আল্লাহর এই বার্তার ধ্বনি দিতে থাকেন :
এমন কেউ প্রশ্নকর্তা কি আছে, যাকে আমি প্রদান করতে পারি?
এমন কেউ তওবা কারী কি আছে, যার তওবা আমি কবুল করতে পারি?
এমন কেউ ক্ষমাপ্রার্থী কি আছে, যাকে আমি ক্ষমা করে দিই?
(ফাযায়েলুল আশহোরিস সালাসা পৃষ্ঠা ১২৬)
ওই মাসটি শেষ হতে চলেছে যে মাসে মহান আল্লাহ তাআলা বকশিশ ও ক্ষমা করার অজুহাত খোঁজেন।
যে মাসে নিঃশ্বাসেও তাসবীহের সওয়াব, যে মাসে নিদ্রায় এবাদত, যে মাসে কুরআন শরীফের একটি আয়াত তেলাওয়াতের সওয়াব হল পুরো কুরআন খতমের সওয়াব,
যে মাসের শুরুতে আমাদের জন্য তাঁর রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল এখন তা বন্ধ হতে চলেছে।
জানি না পরের বছর কে থাকবে আর কে থাকবে না।
তাই আমাদের উচিৎ পবিত্র মাসের বাকি দিনগুলোকে তাঁর পক্ষে থেকে করুণা মনে করে এবাদত-বন্দেগী করা, তওবা করা এবং যথাসম্ভব মাগফেরাত কামনা করা। আর সেই সাথে যতটা সম্ভব আল্লাহর কাছে কামনা করা উচিত। কারণ তিনি এই মাসে আমাদের চাহিদা পূরণ করেন। তাই যতটা সম্ভব আমরা তাঁর কাছে চাই, তিনি দ্বীন ও দুনিয়ার সবকিছু দেবেন। কেবল আমাদের চাইতে হবে।
এই মাসে মহান আল্লাহ তাআলা কতটা করুণাময়ী যে, তিনি আমাদের অনুতপ্ত হওয়ার জন্য, ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য, আন্তরিকভাবে আমাদের পাপ এবং আমাদের ত্রুটিগুলি স্বীকার করার জন্য অপেক্ষা করেন। আমাদের কেবল বলতে হবে : হে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের বকশে দিন, আমরা পাপ করেছি, আমরা অবহেলা করেছি, আমরা অলসতা করেছি। আমরা এই মাস ও এর বরকত ও নূর দ্বারা এবং এর সেহের থেকে লাভ অর্জন করতে পারলাম না।
আর এ মাসে যদি আমাদের ক্ষমা না করা হয়, তবে তা হবে আমাদের বড় দুর্ভাগ্য। কারণ মহানবী (সাঃ) বলেন :
فَإِنَّ الشَّقِیَّ مَنْ حُرِمَ غُفْرَانَ الله فِی هَذَا الشَّهْرِ الْعَظِیمِ
"দুর্ভোগ তার জন্য, যে এই মহান মাসে আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে।"
(আয়ুন আখবার আল-রিদা খন্ড ১ পৃষ্ঠা ২৯৪..প্রকাশক-নাশর জাহান তেহরান।
তাই এই মাসে আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত না হওয়ার চেষ্টা করুন, যতটা সম্ভব তওবা করুন, ক্ষমা প্রার্থনা করুন, যাতে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করেন।
যাইহোক, একজন ব্যক্তির যে জিনিসের যত বেশি মারেফত ও জ্ঞান থাকবে, সে তত বেশি তার কদর করবে।
সেজন্য আমরা যখন মাসুমীন আঃ)-দের বাণী পড়ি এবং তার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করি, তখন আমরা জানতে পারি যে, কিভাবে তাঁরা (আঃ) এই পবিত্র মাসকে বিদায় জানিয়েছেন।
যয়নুল আবেদীন, সাইয়্যিদ আল-সাজিদীন, ইমাম আল-আরেফীন ওয়া আল-সালেকীন ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এই বরকতময় মাসটিকে বিদায় জানানোর সময় বলেছেন :
السَّلَامُ عَلَیك یا شَهْرَ اللَّهِ الْأَکبَرَ، وَ یا عِیدَ أَوْلِیائِهِ
হে আল্লাহর সবচেয়ে মহিমান্বিত মাস এবং হে আল্লাহর ওলীদের ঈদের সময়, তোর উপর আমাদের সালাম।
السَّلَامُ عَلَیك یا أَکرَمَ مَصْحُوبٍ مِنَ الْأَوْقَاتِ وَ یا خَیرَ شَهْرٍ فِی الْأَیامِ وَ السَّاعَاتِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে সময়ের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী এবং দিন ও ঘন্টার শ্রেষ্ঠ মাস।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ شَهْرٍ قَرُبَتْ فِیهِ الْآمَالُ، وَ نُشِرَتْ فِیهِ الْأَعْمَالُ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে বরকতময় মাস, যে মাসে প্রত্যাশা নিকটবর্তী হয়েছে এবং আমলের পৃষ্ঠা প্রকাশিত হয়েছে।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ قَرِینٍ جَلَّ قَدْرُهُ مَوْجُوداً، وَ أَفْجَعَ فَقْدُهُ مَفْقُوداً، وَ مَرْجُوٍّ آلَمَ فِرَاقُهُ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই সাথী, যে ছিল বলে মর্যাদা মহান হয়েছিল এবং যখন বিদায় নিল তখন তার বিচ্ছেদ, দুঃখিত করে তুলেছে। আর তার অস্তিত্ব এমনই আশাপ্রদ ছিল যে তার বিচ্ছেদ বেদনাদায়ক প্রমাণিত হলো।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ أَلِیفٍ آنَسَ مُقْبِلًا فَسَرَّ، وَ أَوْحَشَ مُنْقَضِیاً فَمَضَّ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই প্রিয়তমা! যে ভালবাসার জিনিস নিয়ে এসেছিল এবং আনন্দ দিল এবং যখন সে চলে গেল তখন দুঃখিত ও বেদনা দিয়ে গেল।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ مُجَاوِرٍ رَقَّتْ فِیهِ الْقُلُوبُ، وَ قَلَّتْ فِیهِ الذُّنُوب
তোর প্রতি সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই প্রতিবেশী, যার ছায়াতলে অন্তর নরম ও কমল হয়ে গেছে এবং পাপগুলো কমে গেছে।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ نَاصِرٍ أَعَانَ عَلَى الشَّیطَانِ، وَ صَاحِبٍ سَهَّلَ سُبُلَ الْإِحْسَانِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই সাহায্যকারী, শয়তানের বিরুদ্ধে যে আমাদেরকে সাহায্য করেছে এবং আমাদের এমন একজন সঙ্গী তৈরি করে দিয়েছে, যে নেকির পথকে সহজ ও সরল করে দিয়েছে।
السَّلَامُ عَلَیك مَا أَکثَرَ عُتَقَاءَ اللَّهِ فِیك، وَ مَا أَسْعَدَ مَنْ رَعَى حُرْمَتَك بِك
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, তোর সময়ে কতো বেশি মানুষ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং তোর পবিত্রতা রক্ষা কারী কত ধন্য হয়েছে।
السَّلَامُ عَلَیك مَا کانَ أَمْحَاك لِلذُّنُوبِ، وَ أَسْتَرَك لِأَنْوَاعِ الْعُیوبِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, তুই কতোই না গুনাহ মুছে দিয়েছিস এবং কত প্রকারের দোষ লুকিয়ে রেখেছিস।
السَّلَامُ عَلَیك مَا کانَ أَطْوَلَك عَلَى الْمُجْرِمِینَ، وَ أَهْیبَك فِی صُدُورِ الْمُؤْمِنِینَ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, তুই পাপীদের প্রতি কতটা সদয় ছিলি এবং মোমিনদের অন্তরে তোর ভয় কতোই না বেশি ছিল।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ شَهْرٍ لَا تُنَافِسُهُ الْأَیامُ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই মাস, অন্য কোন যুগ যার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ شَهْرٍ هُوَ مِنْ کلِّ أَمْرٍ سَلَامٌ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হে ওই মাস, যেটি ছিল সর্বদিক দিয়ে নিরাপত্তার কারণ।
السَّلَامُ عَلَیك غَیرَ کرِیهِ الْمُصَاحَبَةِ، وَ لَا ذَمِیمِ الْمُلَابَسَةِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, না তোর সাহচর্য অপছন্দনীয় ছিল আর না তোর সমাজ নিন্দনীয় ছিল।
السَّلَامُ عَلَیك کمَا وَفَدْتَ عَلَینَا بِالْبَرَکاتِ، وَ غَسَلْتَ عَنَّا دَنَسَ الْخَطِیئَاتِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, তুই বরকত নিয়ে এসেছিলি এবং পাপের ঘনত্ব ধুয়ে পবিত্র করে গেলি।
السَّلَامُ عَلَیك غَیرَ مُوَدَّعٍ بَرَماً وَ لَا مَتْرُوك صِیامُهُ سَأَماً
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, হৃদয়ের ব্যথার কারণে তোকে বিদায় জানানো হয়নি এবং শুষ্ক রোজার কারণে তাকে পরিত্যাগ করা হয়নি।
السَّلَامُ عَلَیك مِنْ مَطْلُوبٍ قَبْلَ وَقْتِهِ، وَ مَحْزُونٍ عَلَیهِ قَبْلَ فَوْتِهِ
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, সময়ের আগে তোর অপেক্ষা করা হয় এবং তোর বিদায় নেওয়ার আগেই লোকেরা দুঃখে জর্জরিত হয়ে পড়ে।
السَّلَامُ عَلَیك کمْ مِنْ سُوءٍ صُرِفَ بِك عَنَّا، وَ کمْ مِنْ خَیرٍ أُفِیضَ بِك عَلَینَا
তোর উপর সালাম বর্ষিত হোক, তোর কারণে অনেক মন্দ কাজ আমার থেকে দূরে সরে গেছে এবং অনেক নেককর্ম আমার দিকে ধাবিত হয়েছে।
السَّلَامُ عَلَیك وَ عَلَى لَیلَةِ الْقَدْرِ الَّتِی هِی خَیرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
সালাম বর্ষিত হোক তোর উপর এবং তোর ক্বদরের রাতের উপর যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
السَّلَامُ عَلَیك مَا کانَ أَحْرَصَنَا بِالْأَمْسِ عَلَیك، وَ أَشَدَّ شَوْقَنَا غَداً إِلَیك
সালাম বর্ষিত হোক তোর উপর, তোর জন্য গতকাল আমার কত পরিমাণ কামনা ছিল এবং আগামীকালও তোর প্রতি আগ্রহী হব।
السَّلَامُ عَلَیك وَ عَلَى فَضْلِك الَّذِی حُرِمْنَاهُ، وَ عَلَى مَاضٍ مِنْ بَرَکاتِك سُلِبْنَاه
সালাম বর্ষিত হোক তোর উপর এবং তোর ওই অনুগ্রহের উপর, যা থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আর তোর ওই অতীতের নিয়ামত যা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
আসুন আমরা সেই শব্দগুলি বিবেচনা করি যেগুলির দ্বারা ইমাম (আঃ) পবিত্র রমজান মাসের বিদায় জানাচ্ছেন। একে বলা হয় মারেফত। উল্লেখিত বাক্যের মাধ্যমে ইমাম (আঃ) আমাদেরকে সতর্ক করছেন যে, পবিত্র রমজান মাস কতোই না বরকতময় এবং গুরুত্বপূর্ণ যা আমরা বুঝতে পারি না। আর এটিও একটি হকিকত যে, মাসুম ইমাম এবং পরিপূর্ণ মানুষ ছাড়া আর কেউ এইভাবে পবিত্র রমজান মাসের বিদায় জানাতেও পারেন না। যেমন ইমাম (আঃ) জ্ঞান ও মারেফতে নিমজ্জিত হয়ে এই বরকতময় মাসকে বিদায় জানাচ্ছেন।
এ কারণেই কতিপয় বুযুর্গ ও খোদার ওলীদের সম্পর্কে বলা হয় যে, পবিত্র রমজান মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরা আসন্ন পবিত্র রমজান মাসের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করতেন। কারণ তাঁরা এই পবিত্র মাসের মারেফত ও জ্ঞান রাখতেন। আর সেই সাথে তাঁরা এর ফজিলত ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
হায়! এই মহান মাসটি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে, যার বিচ্ছেদ বেদনা আমাদের জন্য কঠিন এবং অপ্রীতিকর, যার নেয়ামত, রহমত, বরকত এবং ক্ষমা থেকে আমরা এক বছর বঞ্চিত হয়ে থাকব।
পরিশেষে, আমরা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন আমাদেরকে মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং আ'লে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অসিলায় তৌফিক দান করেন, যাতে আমরা এই বরকতময় মাসের বাকি দিনগুলোতে বেশি থেকে বেশি এবাদত ও বন্দেগী করতে পারি। এর সাহের থেকে বেশি থেকে বেশি উপকৃত হতে পারি। আর পাপের ফলে মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তওবা করার এবং ক্ষমা চাওয়ার তৌফিক দান করুন এবং আল্লাহ যেন এই বরকতময় মাসটিকে আমাদের জন্য শেষ মাস না করে দেন।
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ ওয়া আ'লে মুহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম ওয়াহ শুরনা মাআহুম ওয়াল আন আদুওয়াহুম।