লেখা: রাসেল আহমেদ রিজভী
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আল্লাহর অশেষ কারামত, ইমামতের মহান দায়িত্ব ভার ও অসুস্থতাজনীত কারণে কারবালার ময়দানে বেঁচে যাওয়া নবী পরিবারের একমাত্র প্রাপ্ত-বয়স্ক পুরুষ এবং দুঃসহ ও হৃদয় বিদারক কারবালার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইমাম হোসাইনের (আ.) জ্যেষ্ঠ সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) কারবালা পরবর্তী এত এত বেশি কান্না করতেন যে, তাঁর চোখের জ্যোতি কমে গিয়েছিল।
ইমাম জয়নুল আবেদিন ইবনে হোসাইন (আ.) আমৃত্যু অর্থাৎ ৩৩ (মতান্তরে ৪০) বছর পর্যন্ত পিতা ইমাম হোসাইনের (আ.) জন্য কেঁদেছেন। কারবালা সংঘটিত হওয়ার পর এমনটা কখনোই হয়নি যে, তাঁর সামনে কোনো খাদ্য ও খাবার পানীয় রাখা হয়েছে এবং তিঁনি তা দেখে কারবালার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শহীদ হওয়া পিতা, ছয় মাসের দুধের শিশু ছোট্ট ভাই আলী আজগর ও পরিবার-পরিজনের স্মৃতি মনে করে কাঁদেননি, আহাজারি করেননি!
ইমাম জয়নুল আবেদিনের (আ.) শোক ও কান্নাকাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তাঁর একজন খাদেম তাঁকে বলেন, "হে আল্লাহর রাসুলের পুত্র! (আপনার জন্য আমার জান উৎসর্গ হোক) আমি ভয় পাচ্ছি যে, আপনি এভাবে (কান্নার আধিক্যের কারণে) নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলবেন!''
ইমাম তাঁর খাদেম বললেন, ''আমার এই শোক ও দুঃখের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে অভিযোগ-অনুযোগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি এমন কিছু জানি- যা তুমি জানো না। আমি (কারবলায়) এমন কিছু দেখেছি- যা তুমি দেখনি। আমি ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার সন্তানদের হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করে ততক্ষণ কাঁদব, যতক্ষণ না কান্না আমার গলা বন্ধ করে দেয়।'' [মাকারেমুল আখলাক, পৃষ্ঠা- ৩১৬ দ্রষ্টব্য]
এছাড়াও ইমামের আরেক জন খাদেম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ''একদিন ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) মরুভূমিতে যান। আমিও তাঁর পিছু পিছু বেরিয়ে পড়লাম। হযরত দীর্ঘ সেজদা শেষে মাথা তুললেন। দেখলাম- সে অনেক কাঁদছেন, আহাজারি করছেন। আমি বললাম, হুজুর! আপনার দুঃখের অবসান এবং আপনার কান্না ও আহাজারি থামার কি এখনো সময় হয়নি?
তিঁনি বললেন, তোমার জন্য আফসোস! ইয়াকুব (আ.) নবীর বারো জন পুত্র ছিল। আল্লাহ তাঁর মাত্র একজন পুত্রকে (হযরত ইউসুফ আ.) তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য করে দিয়েছিলেন। আর তাতেই ছেলের বিচ্ছেদের দুঃখে তাঁর চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর পিঠ বেঁকে গিয়েছিল এবং অধিক কান্নাকাটির জন্য তার চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অথচ তাঁর সন্তান পৃথিবীতে বেঁচেই ছিলেন; কিন্তু আমি দেখেছি- আমার বাবা, আমার ৬ মাসের শিশু ভাই ও আমার পরিবারের সতেরো জন সদস্যকে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হত্যা পূর্বক শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। বর্শার আগায় বিদ্ধ করে মাথাগুলো শহর থেকে শহরে ঘুরানো হয়েছে। তাদের সঙ্গে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশা করা হয়েছে। তাহলে কিভাবে আমার সেই দুঃখের অবসান হবে এবং আমার কান্না থামবে? [হাদীস দ্রষ্টব্য]
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে একটি বর্ণনায় এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, "ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) তাঁর মহান পিতার জন্য প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কেঁদেছেন- এমন অবস্থায়ও যখন তিঁনি দিনে রোজা রাখতেন এবং রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য দাঁড়াতেন।
ইফতারের সময়, যখন তাঁর খাদেম তাঁর জন্য পানি ও খাবার নিয়ে আসতেন- তখন ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.) বলতেন,
قُتِلَ ابْنُ رَسُولِ اللَّهِ جَائِعاً - قُتِلَ ابْنُ رَسُولِ اللَّهِ عَطْشَاناً.
“আল্লাহর রাসুলের (সা.) সন্তানদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে! আল্লাহর রাসুলের (সা.) সন্তানদেরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে!" এই কথা বারংবার বলতে থাকতেন এবং এমন ভাবে কাঁদতে থাকতেন যে তার অশ্রু তাঁর খাবার ও পানিতে মিশে একাকার হয়ে যেত। আর তিঁনি আমৃত্যু এভাবেই কান্নাকাটি, আহাজারি ও বিলাপ করেছেন।" [হাদীস দ্রষ্টব্য]
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) আদর্শে উজ্জীবীত করুক, কারবালার শিক্ষায় জীবন গড়ার তাওফিক দান করুক। আমিন ইয়া র'ব্বাল আলামিন।