হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০শে জমাদিউস সানী-গোটা মানবজাতির মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ও বিশ্ব-ইতিহাসের শীর্ষস্থানীয় মানুষ নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা (সা:আ:)র জন্মদিন।
বিশে জমাদিউসসানি ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য খুশির দিন। ১৪৪৩ বছর আগের এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন গোটা মানবজাতির মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ও বিশ্ব-ইতিহাসের শীর্ষস্থানীয় মানুষ নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা (সা:আ:)। তাঁর জন্ম হয়েছিল হিজরতের ৮ বছর আগে। বিশ্বনবী (সা:) ও হযরত খাদিজা (সা:আ:)'র মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে জ্ঞান আর মহত্ত্বের শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে উন্নীত হন এই মহীয়সী নারী।
মানব জাতির সর্বকালের সেরা মহামানব ও শিক্ষক পিতা বিশ্বনবী (সা.)'র ওপর মুশরিকদের চাপিয়ে দেয়া নানা কষ্ট আর যন্ত্রণা লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন হযরত ফাতিমা (সা:আ:)। বাবার সেবায় জননীসুলভ অনন্য ভূমিকা রাখার জন্য তাকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মা। অন্যদিকে বিশ্বনবী (সা:)'র পবিত্র আহলে বাইত ও বংশধারা রক্ষিত হয়েছে এই মহামানবীর মাধ্যমে। বেহেশতি নারীকুলের সম্রাজ্ঞী ফাতিমা (সা:আ:)'র পবিত্র জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ। তাঁর ওপর, তাঁর পিতা এবং তাঁর বংশধরদের ওপর বর্ষিত হোক অসংখ্য সালাম আর দরুদ।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা জাহরা (সা:আ:) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ:)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ:)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ:) এবং জাইনাব (সা:)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে।
ফাতিমা জাহরা (সা:আ:) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন আজ ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:আ:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:) কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট।
বিশ্বনবী (সা:)'র রেখে যাওয়া আদর্শকে যথাযথভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরে মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মহানবী (সা:)'র পবিত্র আহলে বাইতের যে ১১ জন ইমাম আবির্ভূত হয়েছেন তাঁদের কাছেও এই মহীয়সী নারী হলেন পরম শ্রদ্ধেয় আদর্শ। এই ১১ নক্ষত্র হলেন হযরত ফাতিমা (সা:আ:)'রই বংশধর। এই এগারো নক্ষত্রেরই সর্বশেষ নক্ষত্র হলেন মানব জাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদি (আ:) যিনি বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার ও ইসলাম প্রতিষ্ঠাসহ সার্বিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের বুকে মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের ধারাকে পূর্ণতা দান করবেন। হযরত ফাতিমা জাহরা (সা:আ:) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও পর্দানশীলতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, বাতুল বা শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে আদর্শ বা অতুলনীয়, আয যাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয জাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি।
হযরত ফাতিমা সিদ্দিক্বা (সা:আ:) ছিলেন একজন আদর্শ জননী, একজন আদর্শ স্ত্রী এবং একজন আদর্শ কন্যা। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন নারীর জন্মকে আরবরা কলঙ্ক বলে মনে করতো। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও নারীরা ছিল অবহেলিত ও উপেক্ষিত এবং এমনকি মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বনবী (সা:)'র কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় মক্কার মুশরিক আরবরা তাঁকে নির্বংশ বা আবতার বলে উপহাস করত। কিন্তু মহান আল্লাহ এসব উপহাসের জবাব দিয়েছেন সূরা কাওসারে। এ সূরায় হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-কে কাওসার বা প্রাচুর্য বলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ এবং কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবেও হয়েছে তাই। কারণ, হযরত ফাতিমা (সা:আ:)'র মাধ্যমে নবীবংশ বা আহলে বাইত (আ:)'র পবিত্র ধারা রক্ষিত হয়েছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)'র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (সা:আ:)। এ সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অসম-সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নবী-নন্দিনী। বিশ্বনবী (সা:)'র ওসিয়ত প্রচার এবং কিভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাবে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বলে মনে করেন অনেক মুসলমান বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক ও আলেম। তাদের মতে, ঐসব নির্যাতনের কারণেই তাঁকে অকালে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে। এমনকি অনেকে মনে করেন, তাঁর কবরও অবমাননার শিকার হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি তাকে গোপনে গভীর রাতে দাফন করতে বলেছিলেন স্বামী আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ:)কে। আজো সকল শ্রেষ্ঠ গুণে গুণান্বিত এই মহীয়সী ও নির্ভীক সংগ্রামী নারীর কবর অচিহ্নিত।
হযরত ফাতিমা (সা:আ:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ:)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:আ:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই। রাসূল (সা:) একবার প্রাণপ্রিয় কন্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতিমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন, তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ:) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে দেখলাম মা ফাতিমা (সা:) এবাদতে মগ্ন। একটানা রুকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন, কিন্তু নিজের জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না, যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে? তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশীর কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা ... ।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:আ:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:আ:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
ফাতিমা সিদ্দিকা (সা:আ:) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তার কাছে জিবরাইল ফেরেশতা আসা-যাওয়া করেছে বিশ্বনবী (সা:)'র মৃত্যুর পর। তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হাসান ও হুসাইন (আ:) কিভাবে মারা যাবেন সেই তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ:)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা:আ:)'র কাছ থেকে।
ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে। বিশ্বনবী (সা:) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা:আ:)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ:)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ:)।
নবী-নন্দিনী (সা:আ:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)’র চেহারার দিকে তাকানো এবং পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত। পবিত্র কোরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়।
ফাতিমা (সা:আ:) রাসূল (সা:)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন।