মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আবারও এসেছে ২১ রমজান । সমগ্র বিশ্ব মহানবীর (সাঃ) পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জন্য শোক প্রকাশ করছে আজ। এই দিনে হজরত আলী (আ.) নশ্বর এ পৃথিবী থেকে অবিনশ্বর জগতে চলে যান এবং হযরত মুস্তফা, হযরত যাহরা ও হযরত জাফর তাইয়ারের সাথে মিলিত হন। ফুযতু ওয়া রব্বিল কা'বা (অর্থাৎ কাবার প্রতিপালকের শপথ ! আমি কামিয়াব ও সফলকাম হয়েছি ) আততায়ী ঘাতক খ্বারিজী মুনাফিক আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদীর তরবারীর আঘাতের সাথে হযরত আলীর ( আ ) এ উক্তি একটি দুগ্ধপোষ্য শিশু মাতৃ স্তনের সাথে যতটুকু পরিচিত ঠিক তার চেয়েও হযরত আলী ইবনে আবী তালিব ( আ ) মৃত্যুর সাথে যে বেশি পরিচিত ও অন্তরঙ্গ ছিলেন এবং তিনি সব সময় শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করতেন সেটার প্রমাণ স্বরূপ এবং তিনি এমন দিনেরই অপেক্ষায় ছিলেন, যে দিনটি ছিল সাফল্য ও কামিয়াবীর দিন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক গাদ্দার উম্মতের জন্য ঐ দিনটি ( ২১ রমযান ) ছিল অধঃপতনের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার দিন। কেননা মহানবী (সা.) আগেই হযরত আলী (আ.)-কে স্বীয় উম্মতের গাদ্দারী , খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে সে সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। হজরত আমীরুল মুমিনীন আলী ( আ ) নিজেই বলেছেন: রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন: আমার পরে উম্মত তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, এবং তুমি আমার ধর্মের উপর জীবন যাপন করবে এবং আমার সুন্নাতের উপর তুমি প্রতিষ্ঠিত থেকে নিহত ( শহীদ ) হবে ; যারা তোমাকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসবে এবং যারা তোমাকে ঘৃণা করবে তারা আমাকেই ঘৃণা করব। আর এটা এখান থেকে অর্থাৎ আলীর দাঁড়ি তাঁর মাথা থেকে রক্তরঞ্জিত হয়ে যাবে ।
إنّ الأمّة ستغدر بک بعدي و أنت تعیش علی ملتي و تُقتَلُ علیٰ سُنَّتِي ، مَنْ أَحَبَّکَ أََحَبَّنِيْ ، و من أبغضک أبغضني وَ إنّ هذه ستُخضَبُ مِن هذا یعني لحیتَه مِن رأسه
( সূত্র : আল-মুসতাদরাক আলাস-সহীহাইন, খণ্ড: 3, পৃ. 353, হাদীস নং 4744. ) এবং হযরত আলী ( আ) বলেছেন: "প্রকৃতপক্ষে, নবী (সা.) আমাকে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে তাঁর (সা) এ কথাটাও ছিল যে এ উম্মত তাঁর (সা) পরে আমার ( আলী ) সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।"
: إنّ ممّا عَهِدَ إِلَيَّ النَّبيُّ ( ص) : أَنَّ الْأَمَّةَ ستغدُرُ بِيْ بَعْدَهُ .
( দ্র : আল-মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, খ : 3, পৃ. 350, হাদীস নং : 4734)
ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন: মহানবী (সা.) আলীকে বললেন : " তবে আমার পরে তুমি ক্লেশ , দু:খ - কষ্ট ও যাতনার শিকার হবে।" আলী বললেন : তাহলে আমি কি আমার ধর্মের ব্যপারে নিরাপদ থাকব ? ", তিনি ( সা ) বললেন: " তুমি তোমার দ্বীনের ব্যাপারে নিরাপদ থাকবে।" (আল-মুস্তাদরাক আলী আল-সহীহীন, খণ্ড: 3, পৃ: 351, হাদীস নং : 4735)
قال النبي ( ص) لعلي :« أمّا أنّک ستلقیٰ بعدي جهداً ». قال : «في سلامة مِن دیني ؟ » ، قال : « في سلامة مِن دینک .» ( المستدرک علی الصحیحین ،ج : ۳ ، ص : ۳۵۱ ، ح : ۴۷۳۵ )
উম্মতের বিশ্বাসঘাতকতা ও গাদ্দারী প্রকাশিত ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেই দিন যেদিন মহানবী (সা.) মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন: " আমার জন্য কাগজ, কলম ও দোয়াত নিয়ে এসো যাতে আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দিয়ে যাব যার জন্য আমার পরে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। " কিন্তু আফসোস, উম্মত রাসুলুল্লাহর (সা.)-এর শেষ অসিয়তটি লিখতে দেয়নি! বরং তাঁর ( সা ) সান্নিধ্যে তারা তুমুল বিবাদ ও তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল এবং নিজেদের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করেছিল যা তাদের করা উচিত হয়নি এবং ঘরে উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলেই উঠল অত্যন্ত স্পর্ধা ও ধৃষ্টতার সাথে : " নবী প্রলাপ বকছেন এবং ( হাসবুনা কিতাবুল্লাহ) আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট ) !!! " এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয় ? এ ধরণের চরম নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ , অত্যন্ত অসম্মানজনক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি দিয়ে সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা উম্মতকে মহানবী (সা.)-এর অন্তিম ওয়াসিয়ত থেকে বঞ্চিত করেছিল এবং এই স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য এতটাই ভীষণ মারাত্মক ও ভয়াবহ ছিল যে ইবনে আব্বাস নিজেই, যিনি এই ঘটনার সাক্ষী ও বর্ণনাকারী ছিলেন, যখনই এ ঘটনার কথা স্মরণ করতেন ঠিক তখনই তিনি খুব কাঁদতেন ( দ্র : সহীহ বুখারী ) ; কারণ, হযরত রাসুলুল্লাহর (সা.)-এর শেষ অসিয়ত যা ছিল উম্মতের হিদায়াতের জামানত ও নিশ্চয়তাদানকারী তা লিখতে দেওয়া হয় নি। যখন এটা লিখতে দেয়া হল না তখন নিশ্চয়ই উম্মত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শেষ দিন গুলোয় পথভ্রষ্ট ও বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। যে উম্মত মহানবীর ( সা. ) একমাত্র প্রিয় কন্যা হযরত যাহরা (সা.)-এর অধিকার হরণ করেছিল, তার বাড়ি আক্রমণ করেছিল, তার পাঁজরের অস্থি ভেঙ্গে তাকে শহীদ করেছিল এবং হযরত আলী যিনি ছিলেন মহানবীর (সাঃ) স্থলাভিষিক্ত , মুসলিম উম্মাহর কর্তৃপক্ষ ( মাওলা ) ইমাম ও পথপ্রদর্শক তাঁকে তারা ( উম্মত ) ২৫ বছর বাড়ির চার দেওয়ালের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ অর্থাৎ অন্তরীন করে রেখেছিল । তারা ( বিচ্যুত উম্মত )
এভাবে প্রকৃতপক্ষে হযরত আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত এবং কারবালার অত্যন্ত দুঃখজনক হৃদয়বিদারক ঘটনার পটভূমি ও ক্ষেত্র তৈরি করেছিল ৷
হযরত আলীর ( আ ) সাথে উম্মতের বিশ্বাসঘাতকতা ও গাদ্দারী আসলেই উম্মতকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে গিয়েছে। আর তাই মহানবী (সাঃ) তাঁর উম্মতকে এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন : হাল্কাতু উম্মাতি আলা ইয়াদাই গিলামাতিন্ মিন কুরাইশ ( আমার উম্মতের ধ্বংস হবে কুরাইশ গোত্রের কিছু যুবকের হাতে। )
هلکة أمتي علی یدي غلمة من قریش
সহীহ বুখারী, পৃষ্ঠা: 1774-1775, হাদীস নং : 3604) এবং বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। কুরাইশ গোত্রীয় এই যুবকরা ছিল আসলে উমাইয়া বংশীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী ( হিযবে উমাভী ) , যাদের নেতৃত্বে ছিল বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী তাগুতী মুয়াবিয়া। দ্বিতীয় খলিফা তাকে ( মুয়াবিয়া ) তার যৌবনকালে দামেস্কের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। আর মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদ ও উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ইবনে আবীহী, যারা ছিল উমাইয়া বংশীয় কুলাঙ্গার যুবক তারা এবং উমর বিন সাদ কারবালার মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের কে অত্যন্ত মযলূম ভাবে শহীদ করেছিল।
হযরত আমীরুল মু'মিনীন আলী (আ.) ও আহলে বাইত (আ.)-এর সাথে যখন উম্মাহর বিশ্বাসঘাতকতা সংঘটিত হয়েছিল, তখন উম্মাহর ধ্বংসও বাস্তবে সংঘটিত হয়েছে , যে সম্পর্কে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতকে অবহিত করেছিলেন এবং সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু উম্মত হযরত রাসুলুল্লাহর (সাঃ) উপদেশ ও সতর্ক বাণী শোনে নি এবং একারণে সত্যিসত্যি তারা ধ্বংসই হয়ে গেছে !!! ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে এ উম্মতের পরিত্রাণের একমাত্র পথ হচ্ছে কেবল আলী ও আলীর পরিবারের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের আনুগত্য করা।
২১ রমজান, হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা সবাইকে আন্তরিক শোক জ্ঞাপন করছি এবং তাসলিয়াত ও সমবেদনা জানাচ্ছি । আর মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যে তিনি আমাদেরকে হযরত আলী (আ) এবং তাঁর বংশধরদেরকে ভালবাসা এবং তাঁদের অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন।
মওলাল মুওয়াহহেদীন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকের দিবসগুলোয় আমাদের জন্য দুআ করবেন ।